বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর টানেল উদ্বোধনের পর শিল্পোদ্যেক্তাদের চোখ এখন আনোয়ারা–কর্ণফুলীতে। এর মধ্যে জমি কিনে অর্ধশত শিল্প কারখানা চালুর বিষয়ে প্রকল্প পরিকল্পনা শুরু করেছেন শিল্পোদ্যেক্তারা। চালুর অপেক্ষায় আছে বেশ কয়েকটি কারখানা। টানেলের মাধ্যমে বিমানবন্দরের সাথে দূরত্ব কমে আসায় বিদেশি বায়ারদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছেন বলে জানিয়েছে কোরিয়ান ইপিজেডসহ নামি–দামি প্রতিষ্ঠানগুলো। টানেলের মাধ্যমে ওয়ান সিটি টু টাউন পরিকল্পনায় মীরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার যে পরিকল্পনা তাতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের আনোয়ারা–কর্ণফুলীতে। প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে টানেল সংযোগ সড়কের মোড়ে চালুর অপেক্ষায় আছে বিশাল পোশাক কারখানা এইচ এস কম্পোজিড টেক্সটাইল। এই পোশাক কারখানায় কর্মসংস্থান হবে প্রায় ৩ হাজার মানুষের। এর আধা কিলোমিটার দূরে সাদ মুসা শিল্পপার্ক রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল (ইপিজেড) হিসাবে কাজ শুরুর চেষ্টায় আছে। বর্তমানে এখানে ৮টি শিল্প কারখানা রয়েছে। ইকোনমিক জোন হিসাবে গড়ে তুলতে ৫শ একর জমি কিনেছেন তারা। নদীর দক্ষিণ তীরে মোস্তফা হাকিম গ্রুপ দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চালু করেছে ইস্পাত ও অক্সিজেন কারখানা। এইচ এম স্টিল ও এইচ এম অক্সিজেন প্লান্ট নামের এই দুই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে প্রায় ২ হাজার শ্রমিক।
টানেল ঘেঁষে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে কোারিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড)। টানেল চালুর পর ১০০ একর জমিতে তাদের হাইটেক পার্ক নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এই পার্কে ২০ তলার ১৮টি ভবন হবে। এছাড়া দুইটি আলাদা প্রশাসনিক ভবনের কাজ শেষ হয়েছে। উদ্যোক্তাদের আশা সফটওয়্যার, শিল্পোন্নয়ন, ডাটা এন্ট্রি ও আউটসোর্সিং খাতে এখানে ৩০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। পাশাপাশি একটি ফ্যাশন ডিজাইন কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কাজও এগিয়ে চলছে। কেইপিজেডের উপ–মহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান আজাদীকে বলেন, টানেল দুটি প্রান্তকে যুক্ত করে শিল্পায়নের বৃহৎ সম্ভাবনা তৈরি করেছে। শিল্প কারখানা হওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করাটাও দরকার। আগে বিমানবন্দর থেকে বায়াররা কেইপিজেডে আসতে দুই ঘন্টার বেশি লাগত। এখন তারা টানেল হয়ে ১০ মিনিটে চলে আসছে। যা আরো বেশি অর্ডার আসার ক্ষেত্রে পজেটিভ ভূমিকা রাখবে।
চট্টগ্রাম চেম্বার, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এস আলম গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, ফোর এইচ গ্রুপ, ডায়মন্ড সিমেন্ট, পারটেক্স গ্রুপসহ অন্তত ৫০টি শিল্পগ্রুপ এখানে শিল্প কারখানা করার জন্য জমি কিনেছে। আগে থেকে কর্ণফুলীতে চালু আছে সুপার ফার্মাসিক্যাল লিমিটেড, পার্টেক্স পেট্রো লিমিটেড, একর্ন ইনফ্রাস্টাকচার সার্ভিস লিমিটেড, বিএন লুব্রিকেন্ট, বেলামি টেক্সটাইল, এটিপি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, জিএসএল এক্সপোর্ট, বেঞ্চমার্ক অ্যাপারেল, ইউসা ব্যাটারি ফ্যাক্টরিসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। আনোয়ারার সাব রেজিস্ট্রার রেজাউল করিম জানান, চলতি বছরের শুরু থেকে এখানে জমি বেচাকেনা বেড়ে যায়। প্রতি মাসে গড়ে ৪শ’জমির দলিল রেজিস্ট্রি হচ্ছে।
তবে শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, যত দ্রুত গ্যাস–বিদ্যুতসহ অবকাঠামো গড়ে তোলা যাবে শিল্পায়ন ততই দ্রুত হবে। বিশিষ্ট শিল্পপতি ও এনসিসি ব্যাংকের ইসি চেয়ারম্যান এস এম আবু মোহসিন বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সড়কপথে যোগাযোগ সহজ করবে। শুধু আনোয়ারা বা কর্ণফুলীই নয়, মীরসরাই থেকে নদীর পার ধরে কক্সবাজার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হবে। পরিপূর্ণ সুফল পেতে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে করতে হবে পরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন। পাশাপাশি ঢাকা–চট্টগ্রাম ৮ লেইন মহাসড়ক, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। শিল্পায়ন যাতে দ্রুত হয় সেভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোগত সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে।
টানেল সংযোগ সড়কের অনতিদূরেই রয়েছে প্রস্তাবিত চায়না ইকোনমিক জোনের অবস্থান। ৭৮৪ একর জমিতে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের গতি বেশ কিছুদিন শ্লথ থাকলেও সম্প্রতি অবকাঠামো নির্মাণে চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ কর্পোরেশন (সিআরবিসি) নামের প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখানে ওষুধ, তৈরি পোশাক, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, রাসায়নিক, স্বাস্থ্য সরঞ্জাম, প্লাস্টিক পণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, ফার্নেস ও সিমেন্ট কারখানাসহ ৩৭১টি শিল্পকারখানা হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ বলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত পেলে কাজে গতি আসবে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ও ৬ লেইনের সংযোগ সড়ক প্রকল্পের পরিচালক সুমন সিংহ জানান, টানেল ঘিরে শিল্পায়ন পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী। বর্তমানে আনোয়ারা ও কর্ণফুলীতে ছোট–বড় মিলিয়ে ১০০টির অধিক শিল্প কারখানা রয়েছে। এসব শিল্প কারখানা যাতে দ্রুত বন্দরে পণ্য পৌঁছাতে পারে আবার কক্সবাজার পর্যন্ত দ্রুত কাঁচামাল নিয়ে যেতে শক্তিশালী সড়ক নেটওয়ার্ক করা হচ্ছে।