একটি দেশের স্বাধীনতা কী তা মর্মে মর্মে বোঝা যায়, যখন সেই দেশটির স্বাধীনতা থাকে না। তথ্য–প্রযুক্তির এই যুগে ইতিহাস থেকে বাঙালি জাতির গৌরব গাথা সেই স্বাধীনতার সত্য ইতিহাস বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারছে, নানা তথ্য উপাত্ত থেকে। কত ত্যাগ–তিতিক্ষা, নির্যাতন, বৈষম্য, বিশ্বাস ঘাতকতা, অবহেলা নৈরাজ্যতার কৃষ্ণগহবর থেকে এ জাতি স্বাধীনতার স্বাদ ছিনিয়ে নিয়েছে তা বিশ্ববাসী দেখেছে। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, শেখ মুজিবুর রহমান এই জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ কী তা বাস্তবে রূপ দিতে সমর্থ হয়েছেন।
১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ এর এক শুভ ক্ষণে জন্ম নেওয়া বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া মানুষটির সারা জীবনের সংগ্রামসাধনা ও নিরন্তর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাঙালি জাতিকে উদ্বুব্ধ করতে বঙ্গবন্ধুর ২৩ বছর সময় লেগেছে, যার মধ্যে তিনি ১৩ বছরই জেলে কাটিয়েছেন। সেই উদ্বুব্ধতার শক্তিতেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছি। স্বাধীনতা অর্জনে এমন দূরদর্শী নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের ইতিহাসে আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না, তিনি তাঁর প্রিয় কবি রবীঠাকুরের বলা লাইনের মত। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বিধাতার রাজ্যে ভালো অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি।’ শুধু বাং লাদেশের মানুষের কাছে নয় সারা বিশ্ববাসীর চোখে বঙ্গবন্ধুর মতো ভালো মানুষ শুধু কম নয়, একেবারে নেই বলে তিনি হয়েছেন শ্রেষ্ঠ বাঙালি, খ্যাতি পেয়েছেন বিশ্ববন্ধুর।
স্বাধীনতা অর্জন, বাঙালি জাতির এক পরম আকাঙ্ক্ষার বিষয় ছিল। সেই পরম আকাঙ্ক্ষার বিষয়কে পাকিস্তানিদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে হয়েছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। পাকিস্তানিরা ছাড়াও বিশ্বের শক্তিধর দেশ আমেরিকা সহ অনেক দেশ বাঙালি জাতি যে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে, অর্থাৎ ভুট্টো বা ইয়াহিয়ার খপ্পর থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে, তা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। এরকম অবিশ্বাস্য কাজ বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে একজন যোগ্য নায়কোচিত নেতার প্রয়োজন হয়, সেই নায়কোচিত নেতাই ছিল বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ছিল অগাধ দেশপ্রেম, এবং অগাধ, ভালোবাসা ছিল এদেশের মানুষের প্রতি যা আমরা তাঁর বিভিন্ন সময়ে বলা বাণীর মধ্যে খুঁজে পায়, তেমন একটি বাণী স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, ‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়, এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা–বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’
বঙ্গবন্ধুর জন্মের আগে থেকেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার সংগ্রাম করে যাচ্ছিল, কিন্তু সঠিক নেতার, সঠিক কৌশলের অভাব ছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়, বঙ্গবন্ধু সেই অভাব পূরণ করে নিজেকে তিল তিল করে গড়ে তুলে বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছে অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত, যার মধ্যে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রায় প্রতিটি দিনই ছিল কোনো না কোনো বাঁক বদলের দিন। তেমনি একটি দিন দিয়েছেন ৭ মার্চ। ৭মার্চ এখন বিশ্বজনীন দিন। ঐ দিনের দেওয়া বক্তব্যই ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসের মোড় ফেরার দিন, জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রারে স্থান করে নেওয়ার দিন, বিশ্বজনীন ঘটনা, বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বক্তব্য প্রদানের দিন, এক অবিস্মরণীয় এবং চিরস্মরণীয় দিন যা ছিল সুকৌশলের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা প্রদানমূলক নির্দেশনা।
বঙ্গবন্ধুর মধ্যে যে একটা আলাদা রকমের নেতৃত্ব ছিল তা তার কথা বলার জাদুতেই নিহিত ছিল। তাঁর কথার জাদুতে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে অভিভূত হয়ে পড়ত। ৭ মার্চের ভাষণের কয়েকটি লাইন ছিল স্তোত্রবাক্যের মতো, তিনি তাঁর অসাধারণ কথার বাণ দিয়ে সমগ্র জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির ঐতিহাসিক আহবান জানিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার দিক নির্দেশনা দিয়ে ছিলেন। যেমন– প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ।’ কিংম্বদন্তী বক্তব্যের মধ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর ১৮ মিনিটের কাব্যকথার শেষে বলেছিলেন স্বাধীনতার স্বাদ অর্জনের সেই চ্যালেঞ্জযুক্ত বাণী, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এবং তার সাথে সাথে উচ্চারিত হয়েছিল সেই অমোঘ স্লোগান ‘জয় বাংলা’। সেই মন্ত্রসুধা শুনেই বাঙালি জাতি তাদের পরম নির্ভরতার নেতা বঙ্গবন্ধুর বাণীকে বুকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার শপথকে অন্তরে জায়গা দিলেন ঐ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় সবসময়ই অগ্রাধিকার থাকতো বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জন ও বাঙলার মানুষের মুক্তি। ১৯৭১ সালের ১৭ই মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫১ তম জন্মদিন। সেদিনও তিনি ইয়াহিয়ার সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্ন উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমার জন্মদিনই বা কী! মৃত্যুদিনই বা কী! জনগণই আমার জীবন’। তাই দেশের জনগণকে স্বাধীনতার স্বাদ দিতে তিনি সাহসের সাথে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে এ দেশের শত্রু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানান এবং ইয়াহিয়া খানের বিরূদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।
একদিকে ইয়াহিয়ার নির্দেশ, অপর দিকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ যেত। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলতো। অফিস, আদালত, ব্যাংক, বীমা, স্কুল–কলেজ, গাড়ি, শিল্প–কারখানা সবই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলেছে। মূলত ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুই স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া–মুজিব–ভুট্টো আলোচনা ব্যর্থ হবার পর ইয়াহিয়া নিরুপায় হয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং বাংলার নিরীহ নিরস্ত্র এবং ঘুমন্ত মানুষের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেন। অসংখ্য মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এক ধ্বংস যজ্ঞ সৃষ্টি করে, ইতিহাসের পাতায় কলঙ্কজনক ২৫শে মার্চের পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা গণহত্যার কালোরাত খোদিত হয়।
ইত্যবসরে বাংলার মানুষের আশা ভরসার নেতা বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন, ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়, এবং এর সাথে বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখা বাংলায় লিখিত একটি বার্তাও সংযুক্ত করেছিলেন। বার্তাটি ছিল ‘ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিয়ারঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতি সমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনওআপস নেই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামীলীগ নেতা কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’(কারাগারের রোজনামচা থেকে )
২৫শে মার্চ রাত ১টা ৩০ মিনিটে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাস এবং তিন দিন পর বন্দি করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম এর আওয়ামীলীগ নেতা এম,এ, হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। সেই থেকে ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু এতো ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা দিবস, তা কুখ্যাত পাকিস্তানি বাহিনী মানবে কেন! শুরু হলো আপামর বাঙালি জাতির স্বাধীনতার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, শুরু হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অকুণ্ঠ সমর্থনে ভারতের মিত্রবাহিনীও যুদ্ধে যোগ দিল। সাধারণ জনগণ দলে দলে আশ্রয় নিল ভারতে, ভারতের উদারতার কোনো তুলনা নেই, ইতিহাসে ভারতের এ বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন। অবশেষে নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীনতার অধিকার আদায় করে নেয় বাঙালি জাতি। স্বাধীনতার মহানায়ক তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। কিন্তু ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে চাপ থাকায় পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরিশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলার জনগণের কাছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের মাটিতে পা ফেলেন। মাত্র তিন বছর এই যুদ্ধ–বিধ্বস্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। দেশি বিদেশি চক্রান্তে বিশ্বাসঘাতক কতিপয় উচ্চাকাঙ্ক্ষী উচ্ছৃঙ্খল বাঙালি সেনা কর্মকর্তার হাতে ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য সপরিবারে নিহত হন। স্বাধীনতার বিনিময়ে বাঙালির কপালে সেঁধে নিল পিতৃহত্যার কলঙ্ক–তিলক। স্বাধীনতার মাস মার্চ প্রতি বছর আসে প্রতিবছর যায়, আমরা স্মৃতি কাতরতায় ভুগি, আমাদের স্বাধীনতার গৌরবগাথা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হিমালয় সদৃশ অস্তিত্বের কথা যিনি মৃত হয়েও জীবন্ত। যত দিন গত হয় মুজিব তত বেশি জীবন্ত হয় বাংলাদেশের আপামর মানুষের কাছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহ–নূর কলেজ।