বঙ্গবন্ধু ও চট্টগ্রাম

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ৩০ আগস্ট, ২০২২ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

আন্দোলন সংগ্রাম এবং মুক্তিসংগ্রামের সকল পর্যায়ে ও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সকল ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের নাম অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে। অগ্নিঝরা আন্দোলন, প্রতিরোধ ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে চট্টগ্রাম সর্বদা অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেছে। মহাত্মাগান্ধীর ভাষায়, ‘সবার আগে চট্টগ্রাম’। ঊপনিবেশিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে চট্টগ্রামের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
১৯৬৬ এর ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে ঐতিহাসিক ৬ দফা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়। (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব. মাজহার ইসলাম, পৃঃ ২৪২ ও ২৬৮)। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদনের পর দেশব্যাপী গণসংযোগের মাধ্যমে জনমত তৈরির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৬ দফার প্রতি প্রথমেই পূর্ণ সমর্থন দিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন ‘চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের এম.এ আজিজ, আব্দুল্লাহ আল হারুন এবং এম.এ হান্নান। ৬ দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাঁরা ১৩ ফেব্রুয়ারি সর্ব প্রথম বিবৃতি প্রদান করেন’। (মোতায়েম সরকার সম্পাদিত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি পৃঃ ৩২৩)
শেখ সাহেব বললেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ২৫ তারিখ লালদীঘির ময়দানে ৬ দফা ঘোষণা করব’। ১৯৬৬ এর ২৫ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে লাখো লোকের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন বাঙালির মুক্তিসনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা। ইতিহাস সৃষ্টি করল চট্টগ্রাম।
ঐতিহাসিক এ জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জহুর আহমদ চৌধুরী। বক্তৃতা করেন, খোন্দাকার মোশতাক, মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম.এ আজিজ, আব্দুল্লাহ আল হারুন প্রমুখ। জনসভায় পঠিত বিশটি প্রস্তাবের মধ্যে ঊনিশটি প্রস্তাব লিখিত ছিল। দ্বিতীয় প্রস্তাব উপস্থিত অলিখিত বিবৃতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং ৬ দফার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে শক্তিশালী করার জন্য এবং এনডিএফ থেকে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনের ব্যয় নির্বাহ এবং গোপন সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য অর্থ জোগানোর উদ্দেশ্যে ১৯৬০-৬১ সালের দিকে চট্টগ্রামের এম.এ আজিজ ও মানিক চৌধুরীকে নিয়ে ‘নতুন এজেন্সী’ নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। খাতুনগঞ্জের ৩৯ রামজয় মহাজন লেইনস্থ মানিক চৌধুরীর পারিবারিক গদিতেই প্রতিষ্ঠানের অফিস স্থাপন করা হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ব্যয় নির্বাহের জন্য ১৯৬৮ এর ২৬ এপ্রিল আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম জেলা কাউন্সিলে ‘মুজিব ফান্ড’ গঠন করার প্রস্তাব গৃহিত হয়। ৬৮ এর মে মাসে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সংসদের বৈঠকে এম. এ আজিজকে চেয়ারম্যান করে ১৫ জন সদস্য নিয়ে ‘মুজিব ফান্ড’ কমিটি গঠন করা হয়।
এম.এ আজিজের উদ্যোগে ১৯৬১ এর ১১ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামে ‘মুজিব দিবস’ পালন করা হয়। মুজিব দিবস উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামে হরতাল পালিত হয়। মুজিব দিবস উপলক্ষে ঐতিহাসিক লালদীঘির জনসভায় লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে সভাপতিত্বে করেন এম. এ আজিজ (এক দফার প্রবক্তা এম.এ আজিজ স্মারক গ্রন্থ : শহীদ শমশির সম্পাদিত)।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তিলাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম জনসভা করতে আসেন চট্টগ্রামে ১৯৭০ এর ৬ ফেব্রুয়ারি। পলোগ্রাউন্ড ময়দানে এ জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ দিন সকাল ৮ টায় পতেঙ্গা বিমানবন্দরে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
১৯৬৭ এর ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। শেখ হাসিনার যখন বিয়ে হয় তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন কারাগারে। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক এম.এ আজিজ তাঁর সঙ্গে জেলখানায় দেখা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ের বিয়েতে আমি উপস্থিত থাকতে পারছিনা। তোমরা আমার সহকর্মী, বন্ধু, বাপ চাচারা আছো, তোমরা দেখো আমার অবর্তমানে মেয়ে যেন অসহায় বোধ না করে। জামাতারও যেন আদর অভ্যর্থনার কমতি না হয়’। এম.এ আজিজ বঙ্গবন্ধুকে কথা দিয়েছিলেন এবং তাঁর কথা রেখেছিলেন।
চট্টগ্রামের নন্দন কাননে ‘চট্টগ্রাম রাইফেল ক্লাব’ ভাড়া করে নবদম্পতির সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিনতম সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ। সেদিন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নিকটতম প্রতিবেশী ডা. সামাদ খান চৌধুরীর বাসার মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠালেন জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে চট্টগ্রামে। ওয়্যারলেসের মাধ্যমেও পাঠালেন। সে কঠিন সময়েও তিনি আস্থা রেখেছিলেন চট্টগ্রামের প্রতি। চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রেরণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু নিজে বর্ণনা করেছেন। ‘স্বাধীনতার অব্যাবহিত পর ঢাকায় আওয়ামী লীগের যে কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।’ সেখানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘চট্টগ্রাম আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, আমি তাঁকে (জহুর আহমদ চৌধুরী) বলি যে, এটাই হয়তো আমার শেষ বাণী। আমি সে সময় দলীয় কর্মীদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে ছিলাম। আমি জহুরকে বলেছিলাম। স্বাধীনতা ছাড়া উপায় নেই। পাঞ্জাবীকে দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাও।’
বঙ্গবন্ধুর জীবনে চট্টগ্রামের যে কয়জন ব্যক্তিত্বকে সঙ্গী ও বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন, যথাক্রমে বিচারপতি আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী, তাঁর বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার কদলপুর গ্রামে। চট্টগ্রামের ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকায় সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক গড়ে উঠে। কলকাতায় মাহবুব-এ আনোয়ার, এম.এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মওলানা আব্দুর রহমান চৌধুরী (এ. আর চৌধুরী), মওলানা আবু তাহের, সালারে জিলা শহীদ শেখ মোজাফ্‌ফর আহমদ, আমীর হোসেন দোভাষ, রাউজান নিবাসী ডা. সুলতান আহমদ যিনি পরে কুমিল্লা গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। একুশে ফেব্রুয়ারী ইউনোস্কোর স্বীকৃতি আদায়ের অন্যতম উদ্যোক্তা কানাডা প্রবাসী আব্দুস সালামের পিতা, লন্ডন শামসু নামে খ্যাত ডা. শামসুল আলম, আবিদর পাড়ার সুলতান কনট্রাক্টর, সুলতানা জুট মিল ও ইউসুফ টেক্সটাইল খ্যাত বুলবুল ইউসুফ, বর্তমানে দেশের অন্যতম শীর্ষ ধনী ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরীর পিতা আশরাফ আলী রোড নিবাসী মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বি.এ, সাবেক সচিব আইয়ুব কাদেরী, সার্জিস্কোপ হাসপাতালের এমডি হাসনাত কাদেরী, মুক্তিযোদ্ধা আনিস কাদেরীর পিতা, পাথরঘাটা নিবাসী কবির উদ্দিন আহম্মদ বি.এ, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সন্তান মাহবুব-এ-আনোয়ার, পাথরঘাটার এম.এ গণি, তারিক আহম্মদ চৌধুরী ও চৌধুরী এনজি মাহমুদ কামাল, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী ভূ-পতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী। ডা. ছৈয়দুর রহমান, বিধান কৃষ্ণ সেন, মকসুদ সর্দার সভাপতি ২২ মহল্লা সর্দার কমিটি, জানে আলম দোভাষ, আনোয়ার বশিরুজ্জামান চৌধুরী, আখতারুজ্জামান চৌধুরী, আতাউর রহমান খান কায়সার, আবুল কাশেম খান, এম. আর সিদ্দিকী, ও এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। (বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবন এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ও চট্টগ্রাম, নাসিরুদ্দিন চৌধুরী)। এছাড়াও আরো অনেকের সাথে সম্পর্ক হয়তো ছিল কিন্তু ইতিহাসে বা লোকমুখে বা গবেষণায় অনেকের নাম হয়তো আসেনি। সেটি হয়তো আমরা বা ইতিহাসের সীমাবদ্ধতা।
চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু যখনি আসতেন। তিনি প্রথম দিকে লালদীঘির পশ্চিম পাড়ে জাকেরুল হক চৌধুরীর ‘আমামিয়া হোটেল, পরে সদরঘাট শাহজাহান হোটেল, কখনো কখনো স্টেশন রোডের মিসকা হোটেল এবং মোটেল সৈকত (সাবেক রেষ্ট হাউস) এ রাত্রিযাপন করতেন। তবে সদরঘাটের শাহজাহান হোটেলে থাকতে বঙ্গবন্ধু বেশি পছন্দ করতেন। কারণ সেখানে টেলিফোন ছিল, পরিচ্ছন্ন হোটেল। তিনি শাহজাহান হোটেলে কর্মীসভাও করেছেন। স্বাধীনতার জন্য যখন বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন তখন তিনি স্টেশন রোডস্থ হোটেল মিসকাতে ছিলেন। এ সময় তিনি ১২ চৈতন্য গলিতে ডা. ছৈয়দুর রহমানের বাড়িতে গোপনে যেতেন এবং বিভিন্ন গোপন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। (সূত্র: বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ও চট্টগ্রাম, নাসিরুদ্দিন চৌধুরী)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির প্রস্তাবক ছিলেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারার কৃতী সন্তান রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ এর ২৯ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম সফর করেন। ১৯৭৩ এর ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার, পটিয়া ও নগরীর পলোগ্রাউন্ডে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। ১৯৭৩ সালের ৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম বন্দরে আকস্মিক সফর করেন। ১৯৭৪ এর ১ জুলাই জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুতে প্যারেড ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জানাজায় অংশ নেন এবং দামপাড়াস্থ বাসভবনে আসেন। ১৯৭৪ সালের অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম নৌ ঘাটি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু যোগ দেন।
১৯৭৫ এর ১৪ জুন ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনে চট্টগ্রামে শেষ সফর। ১৯৭৫ এ ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু রাঙ্গামাটিতে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ উদ্বোধনের জন্য আসেন এবং সড়ক পথে সেখানে যান। (চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গীরা, মুহাম্মদ শামসুল হক)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলন সংগ্রামে চট্টগ্রাম সব সময় বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে লড়ে গেছেন। চট্টগ্রামের নেতৃত্ব সবসময় বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন, সাহস যুগিয়েছেন এবং আন্দোলনের সারথি হিসেবে থেকেছেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, শিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুকে জানা বড় বেশি প্রয়োজন
পরবর্তী নিবন্ধইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব