বঙ্গবন্ধু : একুশ শতকের তারুণ্যের রোল মডেল

কুমার প্রীতীশ বল | শুক্রবার , ১১ আগস্ট, ২০২৩ at ৯:০৮ পূর্বাহ্ণ

এ কোনো কল্পনা নয়, দিনে দেখা স্বপ্নও নয়, একেবারে জরিপের ফলাফল। ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশ ‘বাংলাদেশ দ্য নেক্সট জেনারেশন’ নামে এই জরিপ প্রকাশ করেছে। ২০০৯ সালে বছরব্যাপী বাংলাদেশের তরুণদের ওপর করা এই জরিপে অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল, দেশে তাদের রোল মডেল কে? উত্তরে অধিকাংশ তরুণ বলেছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের রোল মডেল। এই তারুণ্য ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বিচরণ করে। এরা চিন্তাচেতনায় সনাতনী ধারায় বিশ্বাসী নয়, আধুনিক। এদের ৭৪ ভাগ রাজনীতিতে চরমভাবে নিরুৎসাহী। এই তারুণ্যের কাছে তবে কেন বঙ্গবন্ধু রোল মডেল হলেন? বিষয়টি অবশ্যই ভাবতে হবে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের এ বিষয়ক প্রকাশনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ লিখেছিলেন, ‘তার মানে হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দার্শনিক ধারাটা আজকের তরুণদের মধ্যেও বহমান। তরুণদের একটি বড় অংশ (৬৪ ভাগ) মনে করে, পরের পাঁচ বছরে দেশটার মৌলবাদী হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই, সেটা থেকেও একই ধারণাই বেরিয়ে আসে।’

উল্লেখিত জরিপের পাশাপাশি আলোচনার জন্য রাজনীতিবিদ,কলাম লেখক মোনায়েম সরকারের দৈনিক ভোরের কাগজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যার দ্বিতীয় পর্বের একটি লেখা বিবেচনায় নেব। তিনি লিখেছেন ‘ এ প্রসঙ্গে আমার দুটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। বর্তমান জাসদ নেতা মহীউদ্দীন খান বাদলের ছেলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে এতটাই আবেগতাড়িত হয়ে গিয়েছিল যে, সে তার বাবাকে (মহীউদ্দীন খান বাদলকে) বলেছিল, ‘বাবা তোমরা কি এই লোকটার বিরুদ্ধে গিয়ে নতুন দল জাসদ করেছিলে? ‘আই হেট টু টক টু ইউ ফাদার’এ কথার সত্যতা কতটুকু তা জানার জন্য আমি বাদলের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ঘটনাটা সত্য। প্রয়াত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের লেখায়ও এই গল্পটি পড়েছিলাম।

আরেকটি ঘটনাও ঠিক একই রকমের। আমাদের বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে আনান নামের এক কিশোর মাঝে মাঝে আসে। সে ভালোবেসে আমাকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকে। একদিন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে সে তার মাকে বলে, ‘মা জান বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আমার রক্ত গরম হয়ে যায়; আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।’ যে ভাষণের সংগ্রামী বাণী নাবালক শিশুকেও আলোড়িত করে, সেই ভাষণ পরাধীন মানুষকে শেকল ভাঙার শক্তি জোগাবে এটাই তো স্বাভাবিক।’ অনুসন্ধান করলে কিংবা জরিপ চালালে আজও অসংখ্য তরুণের এরকম অনুভূতি পাওয়া যাবে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন বঙ্গবন্ধু আজও একুশ শতকের তারুণ্যের রোল মডেল হয়ে আছেন? প্রশ্নটা উত্থাপন করেই এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। তাহলেই আমরা উত্তর খুঁজে পাব। এজন্য বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং কর্মদর্শণের বিশ্লেষণ করতে হবে। এই বিশ্লেষণ সামষ্টিক চেতনারভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে করতে হবে, আবার ব্যক্তিক পর্যায়েও করতে হবে।

ক্ষণজন্মা এই মানুষটি ধীরে ধীরে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং সর্বোপরি বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে পরিণত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আপোষহীন মানসিকতা, আচরণ, কর্মসমূহ তরুণ প্রজন্মকে রোল মডেল নির্বাচনে প্রেরণা সঞ্চার করেছে। তাঁর প্রতিবাদী মানসিকতাও তাঁকে একুশ শতকের তরুণ প্রজন্মের রোল মডেলে পরিণত করে। তাঁর এই প্রতিবাদী মানসিকতা শৈশব থেকে তাঁর মধ্যে উন্মেষ ঘটে। তাই তিনি ইংরেজের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তিনি শৈশবে বুঝেছিলেন, পরাধীনতা কোনো জাতির উন্নতি, সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে না। আগে দেশকে স্বাধীন করতে হবে। তিনি অধিকার আদায়ে সাহসী এবং আপোষহীন ছিলেন। তাই ছাত্রাবস্থায় অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিনের বাসভবন ঘেরাওয়ের মিছিলে নেতৃত্ব দিতে যখন ছাত্রনেতারা ভয় পাচ্ছিল, তখনই সামনে এগিয়ে যান শেখ মুজিব। প্রধানমন্ত্রীর মুখের উপর শেখ মুজিব বলে আসলেন তাঁদের দাবিদাওয়ার কথা।

বঙ্গবন্ধু আজন্ম সময়ের কাজ সময়ে করেছেন। তিনি সব সময় ঐক্যের রাজনীতি করেছেন। তাই বলে তিনি অন্যায় অসত্যের সঙ্গে আপোষ করেননি। আপোষহীন মানসিকতা শতভাগ বজায় রেখে স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি বাঙালি জাতিকে সর্বপ্রথম ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়ে আবার তিনি দ্বিধাবিভক্ত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বিশ্লেষণ করলে আমরা জানব, তিনি চেয়েছিলেন, এর মাধ্যমে দেশ পরিচালনায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবেন। জনগণের হাতে থাকবে জনগণ দ্বারা পরিচালিত জনগণের সরকারের চাবিকাঠি। এসময় এসে তিনি পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকের বুলেট তাড়া করেছে তাঁর প্রতিবাদী মানসিকতা আর আপোষহীন চরিত্রের কারণে। বিছিন্নতাবাদীরা বঙ্গবন্ধুকে বিছিন্ন করতে চেয়ে জাতির বন্ধন থেকে। মুছে ফেলতে চেয়েছে ইতিহাসের পাতা থেকে তাঁর নাম। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি একুশ শতকে এসেও বঙ্গবন্ধুর প্রভাব বলয় হতে মুক্ত হতে পারেনি। অদূর ভবিষ্যতে যে পারবে তাও মনে হয় না। জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

বাঙালি জাতির রাজনীতির একমাত্র দার্শনিক হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তিনি রাজনীতি করেছেন তত্ত্ব, আর দর্শনের আলোকে। এ কারণে তিনি ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। একই কারণে স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল শুধু কোনো রাজনৈতিক দলের নাম ছিল না। এটা একটি দর্শন। তিনি দেশ গঠন করতে চেয়েছিলেন বাকশালের দর্শনের আলোকে।

বৃটিশ কাউন্সিলের জরিপের তারুণ্যের ভাবনার সঙ্গে তরুণ মুজিবের ভাবনার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, জরিপে ৯৮ ভাগ তরুণ মনে করে সমাজ সেবামূলক উন্নয়ন কার্যক্রমে জড়িত হওয়া দরকার। বঙ্গবন্ধু শৈশবে স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তাদের নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন গরিবদুঃখিদের পাশে। কোলকাতায় পড়তে গিয়েও তিনি একই কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল দর্শনের সমবায় ভাবনায় তাঁর তারুণ্যের সেই স্বেচ্ছামূলক কর্মকান্ডের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আজকের তারুণ্যের ভাবনার সঙ্গে সেদিনের তরুণ শেখ মুজিব এবং রাজনৈতিক দার্শনিক বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনার মিলটুকুর মাধ্যমে উত্তর মেলে, বঙ্গবন্ধু কেন আজও তরুণ প্রজন্মের রোল মডেল।

বাংলাদেশের রাজনীতিকরা চিরকাল এদেশে রাশিয়া, চীন কিংবা মওদুদীর দর্শন চর্চা করেছেন। বৈদেশিক রাজনৈতিক দার্শনিকদের দর্শন এদেশে বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা জীবনপাত করেছেন। বঙ্গবন্ধু একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির মৌলিক দার্শনিক। তিনি বাংলাদেশের জলহাওয়ায় স্বতন্ত্র পথ নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন। বাঙালি জাতির ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির দর্শনও যে বিকশিত হয়েছে, তা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাধারণ বাঙালিরা তা গ্রহণ করে নিয়েছে। অপরদিকে ভিন্ন সংস্কৃতিতে গড়ে উঠা দর্শন আজও সাধারণ বাঙালির গ্রহণযোগ্য হয়নি। মার্কস, লেনিন কিংবা মাসেতুং এরং মতবাদ যতই আধুনিক এবং গণমুখী হোক না কেন তা সাধারণ বাঙালি গ্রহণ করেনি। তাদের অনুসারিদের রোল মডেল হিসাবে গ্রহণ করেনি। এই ধ্রুব সত্যটি এদেশের সাধারণ মানুষের উপলব্ধিতে আসলেও বিদগ্ধজনের আলোচনায় স্থান পায়নি।

বঙ্গবন্ধুর দর্শনে জ্ঞানবিদ্যা, অধিবিদ্যা এবং মূল্যবিদ্যার বিষয়গুলো বিদ্যমান থাকলেও দুর্ভাগ্যজনক সত্য যে, বিশ শতকে বাংলাদেশে পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় দর্শনের মিথস্ক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে দর্শনচিন্তা আমাদের কলেজ, বিশ্বদ্যিালয়গুলোতে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তি হয়, তাতে বাকশাল নামের বঙ্গবন্ধুর দর্শন ভাবনা স্থান লাভ করেনি একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। ফলে তা আলোচনার বাইরে থাকতে থাকতে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন মানুষ বাকশাল নামে শুধু একটি রাজনৈতিক দলকেই বুঝে থাকে। এর বিরুদ্ধে মনগড়া গল্প সাজিয়ে প্রচার করে। এর অন্তর্গত দর্শনকে কেউ সামনে নিয়ে আসতে চাইনি। এমনটি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামীলীগও এ ব্যাপারে শিথিলতা প্রকাশ করে চলেছে। ‘বাঙালির দর্শন’ কিংবা ‘বাংলার রেনেসাঁ ও বাঙালির দর্শন’ পরিক্রমা করতে হলে বাংলার জনপদের হাজার বছরের ইতিহাসের একটি বিস্তৃত প্রেক্ষাপটকে সামনে নিয়ে আসতে হয়। বাঙালির সভ্যতার ক্রম বিকাশের আদ্যপ্রান্ত আলোচ্য পরিক্রমায় চলে আসে। তখন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তারও আগে সেই উয়ারী, বটেশ্বরে প্রাগৈতিহাসিক কালের ইতিহাস কিংবা লারমাই পাহাড়ে প্রাচীনকালে জনবসতি গড়ে উঠার কথকতা সবই সংযুক্ত হয়ে যায়। তখন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দর্শনচিন্তা সাইড লাইনে ফেলে রাখার অবকাশ থাকে না। এই অংশটুকু ‘প্রায়োগিক দর্শন’ হিসাবে অবশ্যই সংযোজিত করতে হবে। কারণ বিশিষ্টজনদের অভিমত, বাঙালির দর্শন মানেই প্রায়োগিক দর্শন। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দর্শনচিন্তা এক্ষেত্রে সংযোজিত হলেই বাঙালির দর্শনচিন্তার ক্রমবিকাশ উন্মোচিত হবে। বাঙালির দর্শন ভাবনাকে সামগ্রিকতা প্রদানের জন্যও এটি জরুরি। বাংলার রেনেসাঁ সঙ্গে বাঙালির দর্শন ভাবনার সমন্বয় করতে হলে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দর্শনচিন্তার ক্রমবিকাশের কথা আলোচনার দাবি রাখে। এতে করে রেনেসাঁ এবং দর্শনউভয়ের প্রকাশ ঘটবে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাকশাল নামের দর্শনচিন্তা এ যাবতকালে একাডেমিকভাবে অনালোচিত থাকার পরও না জেনে কিংবা কম জেনেও সম্পূর্ণ এক প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠেও বঙ্গবন্ধুকে একুশ শতকের তারুণ্য রোল মডেল হিসাবে অনুসরণ করে চলেছে। এটা বিশেষভাবে স্যালুয়েট জানানোর মতো ঘটনা। এক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের প্রায়োগিক দর্শন হিসাবে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দর্শনচিন্তার পথ রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রশস্ত করে দেওয়া উচিত। এতোদিন এই প্রায়োগিক দর্শন সবার জন্য উন্মুক্ত না করে তরুণ প্রজন্মকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদী নায়ক
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা