‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটা এলো কীভাবে

রাশেদ রউফ | রবিবার , ৭ আগস্ট, ২০২২ at ৭:২৮ পূর্বাহ্ণ

১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন। এই দিনে বাংলার দুঃখী মানুষের বন্ধু, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন দেশমাতৃকার সূর্যসন্তান তোফায়েল আহমেদ।
সেই দিন বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি পরিণত হয় জনসমুদ্রে। মঞ্চে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য রেখেছিলেন। চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করে আগেই সভাপতির ভাষণ দেওয়ার জন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ মানুষকে অনুরোধ জানিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ‘সবার শেষে বক্তৃতা করার কথা থাকলেও আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি আগেই বক্তৃতা করতে চাই। সবার সম্মতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আগেই বক্তৃতা করেন তিনি। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে বলেছিলেন, ‘প্রিয় নেতা তোমার কাছে আমরা ঋণী, বাঙালি জাতি চিরঋণী। এ ঋণ কোনোদিনই শোধ করতে পারবো না। সারা জীবন এ ঋণের বোঝা আমাদের বয়ে চলতে হবে। আজ এ ঋণের বোঝাটাকে একটু হালকা করতে চাই জাতির পক্ষ থেকে তোমাকে একটা উপাধি দিয়ে।’
যে নেতা তাঁর জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন সেই নেতাকে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হলো। তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে প্রিয় নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে লাখ লাখ লোক ধ্বনি তুলেছিল, ‘জয় বঙ্গবন্ধু।’
আমরা যখন জানলাম এই ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির নেপথ্য নায়ক বীর চট্টলার আরেক বীর, প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক, তখন গর্বে ফুলে ওঠে বুক। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক মাস্টার দা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক সশস্ত্র যুব বিদ্রোহ সংগঠিত হয় এই চট্টগ্রাম থেকে, একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসি নি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ লিখেছিলেন চট্টগ্রামে বসে কবি মাহবুব-উল আলম চৌধুরী, বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত মহান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন জননেতা এম এ হান্নান চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। এইসব ইতিহাসের সঙ্গে আরেকটি ইতিহাস যুক্ত হতে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক পরিণত হলেন ইতিহাসের অনিবার্য অংশে। রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক আজ বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে যাওয়া একটি নাম।
এতো বড় একটা কাজের গৌরব নিয়ে নীরবে সময় কাটাচ্ছিলেন রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। প্রচারবিমুখ এই মানুষটির গৌরবের এই দিক নিয়ে যখন তাঁর বন্ধুরা কলম ধরলেন, তখন তিনি এলেন আলোচনায়। কিন্তু অনেকে আবার সন্দেহ পোষণ করছিলেন যে বঙ্গবন্ধু উপাধির উদ্ভাবক হিসেবে রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাকের নাম কেন আবার নতুন করে আসছে? সকলের সংশয় আর দ্বিধা কেটে যায় ৬৯’র গণ আন্দোলনের নায়ক, আমাদের জাতির আলোকবর্তিকা তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যের পর। বঙ্গবন্ধু উপাধির ৫০ বছর উপলক্ষ্যে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ দেশটিভির একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তোফায়েল আহমেদ নিজেই স্বীকার করেছেন বঙ্গবন্ধু উপাধিটি তাঁর আগে এক লেখায় লিখেছিলেন তাঁরই কর্মী ছাত্রলীগনেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। তোফায়েল আহমেদ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। ইতিহাসের সত্য ঘটনা তুলে ধরে তোফায়েল আহমেদ পরিণত হলেন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বে। তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা আমি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার স্মৃতিচারণ করে রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক বলেন, “১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ ‘প্রতিধ্বনি’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা বের করত। সে পত্রিকার একটি সংখ্যায় আমি ‘সারথী’ ছদ্মনামে ‘আজবদেশ’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখি। লেখাটার শেষ দিকে ‘বঙ্গশার্দূল’ শেখ মুজিবের পাশে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ব্যবহার করি”। তিনি বলেন, “শেখ মুজিবের নামের সাথে সুনির্দিষ্ট কোনো বিশেষণ তখনও যুক্ত হয়ে ওঠেনি। বিভিন্ন জনবিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন নামকরণ করলেও কোনোটি তেমন স্বীকৃতি লাভ করেনি। শেখ মুজিবুর রহমান তখনও ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে পরিচিত নন। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে তিনি মুজিব ভাই সম্বোধনে পরিচিত। ১৯৬৬ সাল থেকে তার নামের আগে তরুণ সমাজ ‘সিংহশার্দূল’, ‘বঙ্গশার্দূল’ ইত্যাদি খেতাব জুড়ে দিতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবের নামের সাথে একটি যথাযথ বিশেষণ যুক্ত করার চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। তখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অসারতা উল্লেখ করে আমি একটি নিবন্ধ রচনা করি।
চার পৃষ্ঠাব্যাপী এই নিবন্ধে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে দুটো পৃথক অঞ্চল হিসেবে পাকিস্তানের দুই অংশের সম্পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্ট্যকে জোরালোভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই নিবন্ধে গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের নামের সাথে প্রচলিত বিভিন্ন বিশেষণের পাশাপাশি সর্বপ্রথম লিখিত আকারে আমি ‘বঙ্গবন্ধু’ বিশেষণটি ব্যবহার করি।” বলাবাহুল্য, তখন থেকেই শেখ মুজিরের নামের সাথে এতদিনের প্রচলিত ‘মুজিব ভাই’, ‘বঙ্গশার্দূল’, ‘সিংহশার্দূল’ ইত্যাদি বিশেষণকে রীতিমতো প্লাবিত করে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটিই সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটি পরবর্তীকালে তার নামের সাথে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে, ‘বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণ করলে আর শেখ মুজিব বলতে হয় না। একইভাবে শেখ মুজিব নাম উচ্চারিত হলেই ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটিও চলে আসে অবলীলায়। আজ শেখ মুজিব মানে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধু’ মানেই শেখ মুজিব। [সমকাল ১৯ মার্চ ২০১৭]
‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির প্রণেতা, সাবেক ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাকের জন্ম ১১ আগস্ট ১৯৫০, চট্টগ্রামের আনোয়ারায়। গত ১৫ জুলাই ২০২১ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। তিনি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে শুধু ইতিহাসের অংশ হননি, নিজেই পরিণত হয়েছেন ইতিহাসের স্রষ্টায়। ‘বঙ্গবন্ধু’- এই শব্দটি কত সহজ, অথচ কত গভীর, গম্ভীর এবং দিগন্তবিস্তারী, তা তাঁর আগে কেউ ভাবে নি। তাঁর দেওয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে গেলো এক শাশ্বত, চিরকালীন ও জনপ্রিয় খেতাব। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দের মধ্যে যে দ্যোতনা আছে, ব্যঞ্জনা আছে, তার কোনো বিকল্প শব্দ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আজ শেখ মুজিবুর রহমান নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যে শব্দটি উচ্চারিত হয়, সেটি বঙ্গবন্ধু।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅভ্যন্তরীণ নৌ রুটে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা
পরবর্তী নিবন্ধদিনভর পথে পথে দুর্ভোগ