বঙ্গবন্ধু : অবিনশ্বর ও অমর সত্তা

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ১৬ আগস্ট, ২০২২ at ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ


১৫ আগস্ট, এ দিনটি কয়েক হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বাঙালির জাতিসত্তা এবং বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের একটি ঘৃণ্যতম দিন, কলঙ্কের দিন। বাঙালির ইতিহাসে গভীর কালিমাময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। এ দিন বাঙালির ইতিহাসে এক মহানায়কের প্রয়াণের দিন। এ দিন ইতিহাসের গভীরতম শোকের দিন। এ দিনে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি ইতিহাসের রাখাল রাজা খ্যাত মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
নটরডাম কলেজের জনৈক মার্কিন অধ্যাপক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্দেশ্য একবার বলেছিলেন, তিনি একজন রাজনৈতিক কবি। একজন বিদেশী বুদ্ধিজীবী বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। সার্থক কবি মাত্রই দার্শনিক—তাদের নিজস্ব মৌলিক চিন্তাধারা থাকে। আর সে চিন্তাধারা মহৎ আদর্শে অনুরঞ্জিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন দর্শনের মৌলিক তাৎপর্য হলো; ত্যাগের মাধ্যমে মহত্তর ও কল্যাণকর লক্ষ্য অর্জন। পাকিস্তানের লৌহমানব খ্যাত আইয়ুব খানের শাসনামলের শেষদিকে এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের শাসনকালে তিনি আদর্শ বিসর্জন দিয়ে অনায়সেই জীবনকে ভোগের মধ্যে ডুবিয়ে উপভোগ করতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রীত্বের সুযোগ তাঁর জীবনে এসেছিল। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সাথে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেননি। তিনি তাই দুঃখের পথ, বেদনার পথ, কণ্ঠকাকীর্ণ পথই বেঁচে নিয়েছিলেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে ত্যাগী ও আত্মসুখ বিসর্জনকারী মহান ব্যক্তিদের তালিকায় তাঁর নামও যুক্ত হবার দাবি রাখে। তিনি যদি পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার কারগারে মারা যেতেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বিচারের প্রহসন করে তাঁকে হত্যার যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন তা যদি কার্যকর হত, তাহলে তাঁর মর্যদা সাম্প্রতিককালের বিশ্ব ইতিহাসের প্যাত্রিস লুমুম্বা, চে-গুয়েভারা বা আলেন্দের চেয়েও মর্র্যদার সাথে লিখিত হত।

সুতরাং ত্যাগের মাধ্যমে জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে এবং মৃত্যুকে পরোয়া না করে তিনি একটি গোটা জাতিকে সংগ্রামমুখী করে তুলেছিলেন, নিয়মাতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর মূল্য সাম্প্রতিককালের সকল মানবেতিহাসে কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। ত্যাগ এবং সংগ্রাম, স্থির লক্ষ্যেও নিরলস প্রয়াস। নিয়মতান্ত্রিক পথ ও বিপ্লব… এই সবকিছুর অপূর্ব সমন্বয় তাঁর জীবনের বিগত দিনগুলোকে উজ্জ্বলতা দান করেছে। এগুলো তাঁর জীবন দর্শনের এক দিক। ত্যাগও যাত্রাপথে অকুতোভয় চলমানতা তাঁর জীবন দর্শনের ভিত্তি নির্মাণ করছে।

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রবাহের বিকাশ ও বাঙালি জাতির চেতনার স্তরকে সামনে রেখেই বঙ্গবন্ধু এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে নেতৃত্বের পথে এগিয়ে এসেছেন। এ যাত্রার মূল লক্ষ্য একটি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা, শোষিত বাংলাকে সোনার বাংলায় পরিণত করা।

বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন সাধারণ এক পরিবারে। কিন্তু দিনে দিনে তাঁর কর্ম ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং মানুষের ভালোবাসায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ। একেকার হয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবন আর বাংলাদেশের ইতিহাস। বাঙালিকে উন্মুখ করে তুলেছিলেন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়। বাঙালির জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অনন্য এক রাষ্ট্র, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

‘আমি ফেরেশতা নই, শয়তানও নই, আমি মানুষ, মানুষকে ভালোবাসি, দেশকে ভালোবাসি, আমার চরিত্রের শক্তি মানুষকে ভালোাবাসা, দুর্বলতা ও মানুষকে ভালোবাসা’। এই অসাধারণ কথা যিনি বলতে এবং বলার সাহস রেখেছিলেন তিনি হলেন, একটি রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির পিতা এবং একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান।

তিনি বিশ শতকে একটি অসাম্প্রদায়িক জাতির দেশ তৈরি করেছেন। যে দেশটির নাম বাংলাদেশ। তিনি একটি বিলুপ্তপ্রায় জাতিসত্তা পুনঃনির্মাণ করেছেন। সেই জাতির নাম বাঙালি। তিনি এই বাঙালি জাতির জন্য একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে গেছেন। তার নাম অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে একটি স্বপ্ন দর্শন উপহার দিয়ে গেছেন। সেটি হচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক একটি অসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী তৈরি করার দর্শন। যে জনগোষ্ঠীর নাম বাঙালি’।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর চার দশকের বেশি হয়েছে বাংলার জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৭ কোটি। বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল ১৯২০ সালে। তখন ভারত ও বাংলাদেশ অবিভক্ত। তুরস্কের ইসলামী খেলাফত ব্রিটিশ সাম্প্রজ্যবাদীরা ধ্বংস করে দিয়েছিল। ভারতের মুসলমানরা কংগ্রেসের সহযোগিতায় খেলাফত আন্দোলন শুরু করার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। আর কংগ্রেস ব্যস্ত অসহযোগ আন্দোলনে। শিশু মুজিব সম্ভবত অসহযোগের আবেগ ধারণ করেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। খেলাফত আন্দোলন তাঁকে প্রভাবিত করতে পারেনি। পরিণত বয়সে তিনিও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছেন। অতীত মুখী খেলাফতের রাজনীতি তাঁকে কোনোভাবেই আকৃষ্ট করেনি।

লক্ষ্য করার বিষয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রথম জীবনে মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক সহযোগী ছিল মুসলিম লীগের ভেতর প্রগতিশীল অংশ। প্রথম সুযোগই তিনি ছাত্রলীগকে এবং তারপর মওলানা ভাসানীর সহযোগী হয়ে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই উপমহাদেশে প্রথম নেতা, যিনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট কোনো দলের পতাকা থেকে চাঁদ তারা বাদ দেন এবং ধর্মীয় স্নোগানের পরিবর্তে জয় বাংলা স্নোাগান প্রবর্তন করেন। দলীয় সভা শুরু করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ সংগীত পরিবেশন দ্বারা। তিনি একমাত্র নেতা যিনি সাহসের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত বিশ্বাসে আমি একজন খাঁটি মুসলমান, কিন্তু পরিচয়ে আমি প্রথমে বাঙালি এবং শেষেও বাঙালি’। তাঁর চিন্তা চেতনায় এবং আদর্শে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মানুষকে তিনি একটি আধুনিক, স্পষ্ট, বাস্তব রাষ্ট্রদর্শনই উপহার দিয়ে গেছেন।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির কুলঙ্গার সন্তানেরা তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার স্বাপ্নিক পথ চলা। বাংলার মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যে দর্শন তিনি তাঁর জীবনের সর্বস্ব ত্যাগের মাধ্যমে অর্জনের পরিকল্পনা ও স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছিলেন এবং বাঙালির নিকট অঙ্গীকারকৃত দর্শনের বিনাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ঝাঁপির ভিতর থেকে বিষাক্ত সাপ যেমন বার বার ফনা তোলে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসব বর্ণচোরা সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত সাপ বার বার ফনা তুলেছে। বর্তমানে এই বিষাক্ত সর্প দংশন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেই জাতিকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে নিয়ে যেতে নিরলস পরিশ্রম করছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু বিহীন বাংলায় বাংলাদেশ আছে, বাংলাদেশে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে বাঙালি এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে।

১৯৭১ এর আগে বাঙালি দুটো প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনে ছিল। ১৯০ বছর ইংরেজের অধীনে। ২৩ বছর পাঞ্জাবি ও উর্দুভাষী সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের অধীনে। এই দুই ঔপনিবেশিক শাসন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশটিকে পরিণত করেছিল পৃথিবীর দরিদ্রতম রাষ্ট্রগুলোর একটিতে (বর্ণিয়ার, টের্ভালিয়ার প্রমুখ পরিব্রাজকের বর্ণনা হতে)।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনের ২৩ বছরের মধ্যে ১৩ বছরই কাঠিয়েছেন কারান্তরালে বাঙালিকে পরাধীনতামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত, অর্থনৈতিকভাবে ঋদ্ধ একটি অস্তিত্ব্ব বা জীবন প্রদান করতে। যে জীবন হবে ক্ষুধামুক্ত স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র বইটির পাতায় পাতায় এই ঐকান্তিক ইচ্ছা বা আকুলতা বার বার ফুটে উঠেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের একমাত্র বাঙালি যিনি বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা বাংলা ভাষার অধিকার আদায়, বাঙালির নিজস্ব জাতি-রাষ্ট্র গড়ে তোলা এবং বাংলাদেশের স্বাধীন অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তোলার প্রাণ পুরুষ। এ কারণেই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫, পাকিস্তানপন্থী যুদ্ধপরাধী দেশদ্রোহীরা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি। তাঁর পরিবারের সতেরো জন সদস্য, যাদের মধ্যে নারী, শিশুরাও ছিলেন। তাঁদেরও নিমর্মভাবে হত্যা করেছিল ঘাতকরা। ১৯৮১ এর মে মাসে বঙ্গবন্ধুর যে দু’জন কন্যা এই ঘৃণ্যতম অপরাধীচক্রের হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে ব্রত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশ আবার নতুন পথের সন্ধান পায়। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর একুশ বছর পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার বাংলাদশের উন্নয়নের রথযাত্রার সারথী হয়।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে মুক্তির ঠিকানা দিয়েছেন। তাই তিনি বাঙালির জন্য অবিনশ্বর ও অমর সত্তা।

লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঙালি জাতির মুক্তির দূত
পরবর্তী নিবন্ধপরিকল্পনাকারীদের খুঁজে বের করতে কমিশন গঠন সময়ের দাবি