১৫ জুন, ১২১৫ খৃষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা জোহান কর্তৃক ঘোষিত এবং স্বীকৃত ‘জন অধিকারের ফরমান’ তথা ঘোষণা বলে অবদমিত ইংল্যান্ডবাসী পেয়েছিল প্রকৃত স্বাধীকার ও মুক্তির স্বাদ। রাজা জোহান কর্তৃক ঘোষিত এই ফরমানটিই বিশ্বে ঐতিহাসিক ‘ম্যাগনা কার্টা’ নামে খ্যাত। ঐতিহাসিক ‘ম্যাগনা কার্টা’র আদলেই পরাধীন বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশেও রচিত হয়েছিল নূতন এক ‘ম্যাগনা কার্টা’। ভাগ্যাহত নিপীড়িত বাঙাল জাতির এই ‘ম্যাগনা কার্টা’ হলো- ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা’।
এই ছয় দফা কর্মসূচিকে বাঙালি জাতির মুক্তির মহাসনদই্ বলা যায়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। ইতোপূর্বের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, সংবিধান প্রবর্তন বা সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন পূর্বপাকিস্তানের বিশেষ শ্রেণি তথা শিক্ষিত, সচেতন ও প্রগতিশীল লোকদের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ ছিল। এগুলোতে ছাত্রসমাজের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। আর গোড়া থেকেই সর্বস্তর ও পেশার মানুষের মুক্তির আন্দোলন হিসেবে ছয় দফা কর্মসূচি সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এতে সরাসরি নেতৃত্ব প্রদান করেন, এর প্রচারণায় অংশ নেন এবং একে সুসংগঠিত করেন। তাঁর নির্দেশনায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো শ্রমিক সংগঠনসমূহ আন্দোলনমূখী হয়। এ কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জাতীয় অবিসাংবাদিত নেতায় পরিণত করে। তার নির্দেশনায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো শ্রমিক সংগঠনসমূহ আন্দোলনমুখী হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত হয়ে ওঠে। যে কারণে ছয় দফা কর্মসূচির আন্দোলনের সময় শীর্ষ ও মাঝারি সারির প্রায় সব আওয়ামী লীগ নেতা বন্দি হলেও এর আন্দোলন সাধারণ মানুষই অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ কারণেই ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ঘোষিত ১১ দফার মধ্যে ছয় দফা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যেন যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একে নির্বাচনী ইশতিহারে সন্নিবেশিত করেন এবং একই সাথে চূড়ান্ত ভাবে একে নির্বাচনী ইশতিহারেও সন্নিবেশিত করেন এবং চূড়ান্ত ভাবে একে নির্বাচনী ম্যান্ডেট হিসেবে ঘোষণা করেন। এ কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র, জনতা, শ্রমিক ও পেশাজীবী লোকদের মধ্যে যে অনন্য ঐক্য গড়ে ওঠে- ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার ফল পাওয়া যায়। ছয় দফা কর্মসূচিতে আন্দোলনকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে এ অঞ্চলের মানুষ অবিশ্বাস্যভাবে একক সমর্থন দান করেন। আর এ আন্দোলনের বিরোধীরা রাজনীতির মঞ্চ থেকে পুরোপুরি বিদায় হয়। কিন্তু নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেননি বিধায় ছয় দফা কর্মসূচিতে আন্দোলনের ধারা নতুন চেতনায় পরিবর্তিত হয়। তিনি বাঙালি ও বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, আর বাঙালি জাতি চূড়ান্তভাবে সবকিছু অর্জন করেন মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। এভাবে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের আন্দোলনের ধারায় ছয় দফা কর্মসূচিকে বলা যায় বাঙালির মুক্তির মহাসনদ-তথা বাঙালির ম্যাগনাকার্টা।
ছয়দফা কর্মসূচি পাকিস্তানের দু অংশের মধ্যকার বৈষম্য এবং পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক শাসনের অবসানের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ঘোষিত কর্মসূচি। তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলা ও ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোচ্চার হন। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতারা তাসখন্দ-উত্তর রাজনীতির গতিধারা নিরূপণের উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলন আহবান করেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলনে যোগদানের জন্য ৪ ফেব্রুয়ারি লাহোর পৌঁছেন। পরদিন সাবজেক্ট কমিটির সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি হিসেবে ‘ছয়দফা’ প্রস্তাব পেশ করেন এবং তা সম্মেলনের আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রপত্রিকায় ছয়দফার বিবরণ ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে চিহ্নিত করা হয়। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন।
প্রকৃতপক্ষে ছয় দফার সামগ্রিক প্রণেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে। এগুলো তাঁর সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, ত্যাগ ও প্রজ্ঞার ফসল। দীর্ঘকাল তিনি দেশ ও দশের সমস্যা সম্পর্কে যে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন, ছয় দফায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
ছয় দফায় বিধৃত দাবিসমূহ নিম্নরূপ:
১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে।
২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে।
৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকবে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকস্তিান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার ব্যবস্থা সম্বলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে।
৪. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোন হারে আদায় করা হবে।
৫. দুই অংশের মধ্যে দেশীয় পণ্য বিনিময়ে কোন শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং রাজ্যগুলো যাতে যেকোন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।
৬. প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।
ছয় দফা বাঙালিকে এক স্বতন্ত্র আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজেকে চিনতে ও জানতে শিখিয়েছে। ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই আন্দোলন, নির্বাচন ও স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্ভব হয়েছে ছয় দফার জন্যই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের ফলে একদিকে ছয়দফা কর্মসূচির পরিসমাপ্তি ঘটে এবং নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। আর তাই ৬ দফা-ই আজ বাঙালি জাতির ‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
লেখক : সামুদ্রিক পরিবেশ গবেষক ও অধ্যাপক