জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির জীবনে দুই মহান পুরুষ। একজন বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, আরেকজন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মূল স্তম্ভ। দুজনই বিশ্বমানবতা এবং বিশ্বশান্তির জন্য নিবেদিত প্রাণ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধসমূহে সমাজ পরিবর্তনের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। তাঁর কাব্যে বঙ্গবন্ধু প্রেম, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা এবং মানবিকতা খুঁজে পেয়েছেন। তিনি মনে করেন রবীন্দ্রনাথের বইগুলি সমাজ পরিবর্তনের এবং পুননির্মাণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর মতে, রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি‘ এমন একটি কাব্যগ্রন্থ যা মানবিকতার উচ্চতর আদর্শগুলির একটি সংকলন। সমাজের পরিবর্তন ও উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
বাঙালির আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদাবোধ বিকাশের মূলেই রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুজনই বাংলার মানুষের জীবনসংগ্রাম, দুঃখ–দুর্দশা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। রবীন্দ্রপ্রেমে আপ্লুত বঙ্গবন্ধু আজীবন রবীন্দ্রনাথকে চিত্তে ধারণ করেছেন। কবিগুরুর লেখা ও গান তাঁকে দেশপ্রেমে উজ্জ্বীবিত করেছে। কবিগুরুর আজীবন সত্য ও সুন্দরের নিরন্তর সাধনা এবং মানুষের জন্য নিঃশর্ত ভালোবাসা বঙ্গবন্ধুর অন্তরে প্রেরণা সঞ্চার করেছিল।
বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের বিচরণক্ষেত্র আলাদা হলেও লক্ষ্য এক, বাংলার জয়, বাঙালির জয়। ব্যক্তিগত জীবনে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা, আদর্শ বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রাণিত করেছে। বাসায় থাকলে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান তাঁর সারাদিনের সঙ্গী। রোজ রাতে শুনতেন, ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা/ তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।’
তীক্ষ্ণবুদ্ধি, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও মেধাবী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একজন রাজনীতিকই ছিলেন না, ছিলেন সাহিত্য সচেতন একজন ব্যক্তি। যতবার জেলে গিয়েছেন, ততবার তাঁর একমাত্র সঙ্গী রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা‘। রবীন্দ্রনাথের অসামপ্রদায়িক চেতনা বঙ্গবন্ধুকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর কবিতা বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেছে। রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন ভাষণে তিনি তাঁর প্রিয় পংক্তি ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি ’– ‘বঙ্গমাতা’র এই কবিতার চরণ অথবা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’ –জনপ্রিয় চরণসমূহ ব্যবহার করতেন।
নিজের দেশে বাংলা ভাষা এবং কবিগুরুর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু যেমন প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন তেমনি বৈশ্বিক পর্যায়েও বাংলা ভাষা ও বিশ্বকবির শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব উন্মোচনে তিনি ছিলেন চিরজাগ্রত। বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের মত মহামানবের মিলনকে বিশ্বাস করতেন। ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ (সভ্যতার সংকট)-এই কথা বঙ্গবন্ধু আজীবন হৃদয়ে ধারণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সুখ– দুঃখের সাথীও রবীন্দ্রনাথ। ১৯৬৬ সালের ২৭ এপ্রিল পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৪৭ ধারা বলে বঙ্গবন্ধুকে ১৫ মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড দেন কোর্ট। তখন দুঃখ করে, হতাশ হয়ে বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের কবিতার কথা স্মরণ করেন। ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর / এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়‘- ( সূত্র : ‘কারাগারের রোজনামচা‘-পৃষ্ঠা : ২৩০–৩১)।
১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে পরেরদিন সোহরাওয়ার্দী ময়দানে সংবর্ধনা সভায় দেয়া ভাষণে রবীন্দ্রপ্রীতি ও বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর ভালোবাসার উজ্জ্বল চিত্র ফুটে উঠেছে। সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা মীর্জা গালিব, সক্রেটিস, শেকসপিয়ার, এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও –সে–তুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথ এর লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় লিখে বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা রবীন্দ্রনাথ এর বই পড়বোই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবোই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গীত হবেই।’
মানুষের মুক্তি, মানুষের কল্যাণই ছিল রবীন্দ্রনাথের সকল সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। বঙ্গবন্ধু আজীবন আঁকড়ে ধরেছেন মানুষ, মনুষ্যত্ব আর জাগতিক বিশ্বের সকল সুন্দরকে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেন। সেদিন পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে রেসকোর্সের ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’র বিপরীতে অশ্রুভেজা কন্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কবিগুরু তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ রবীন্দ্র গবেষকরা মনে করেন এর থেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য কবিগুরুর প্রতি দেশনায়কের আর কি হতে পারে?
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধু নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন । প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণের কিছুক্ষণ পরেই সাংবাদিক যখন জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার আজকের দিনে জাতির প্রতি আপনার বাণী কি?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের কবিতার চরণে বলেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রনাথ বর্জনের যে প্রচেষ্টা ছিল, তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন স্বাধীনতার পর। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’–রবীন্দ্রনাথের এই গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করে।
বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ পরিচয় তিনি একজন বাঙালি। রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম, সুন্দরের আরাধনা, প্রকৃতিপ্রেম, মানবিকবোধ বঙ্গবন্ধুকে ভীষণভাবে নাড়া দিত। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত জীবনে রবীন্দ্রনাথের বিশাল প্রভাব সম্পর্কে বেগম মুজিব বলেছিলেন, ‘কবিগুরুর আসন বঙ্গবন্ধুর অন্তরের অন্তস্থলে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের উত্থান পতন, সুখ, দুঃখ, দৈন্যের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁকে দেখতাম রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতে।’
গোলাম কুদ্দুছ ‘বঙ্গবন্ধুর জীবনে রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক লেখায় বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথের জীবনে আমরা মিল খুঁজে পাই দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে। দু’জনের জীবনাদর্শ এক ও অভিন্ন। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশিকতা ও বিদেশী পণ্য বর্জন এবং বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন এ দুইয়ের পরতে পরতে আছে বাঙালির আত্মসচেতনতা, আত্ম আবিষ্কার ও স্বদেশপ্রেম।’
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সমর্থন, শরণার্থীদের আশ্রয়দান, প্রবাসী সরকার গঠনে সহায়তা এবং আমাদের সেই দুর্দিনের সাথি ও আশ্রয়দাতা ভারতের মহান জনগণ ও সরকারের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা সফরে যান। কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ভারতের ইতিহাসের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভারতবাসীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। কলকাতার ওই জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। বক্তৃতা চলার সময় উপস্থিত জনতা মাঝে মাঝেই বঙ্গবন্ধুকে আবদার করেছিলেন কবিতা বলার জন্য। বঙ্গবন্ধু প্রত্যেকবার হেসে শ্রোতাদের আবদার রক্ষা করেছিলেন। তিনি যেসব কবিতার অংশবিশেষ শোনাচ্ছিলেন, সব কবিতাই রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথ যে বঙ্গবন্ধুর জীবনে প্রেরণার স্থান দখল করে আছেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
ওইদিনের জনসভাস্থলে সমবেত কণ্ঠে শুরুতে গাওয়া হয় ‘বাঁধ ভেঙে দাও’ এবং সব শেষে কবিগুরুর লেখা দুটি জাতীয় সংগীত, দুই প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রের, ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ‘জনগণমন’।
তথ্যসূত্র : শেখ হাসিনা– ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, গোলাম কুদ্দুছ– ‘বঙ্গবন্ধুর জীবনে রবীন্দ্রনাথ’, ড. মো আনোয়ারুল ইসলাম– ‘বঙ্গবন্ধুর ভাবনাদর্শে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’, উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট থেকে পাওয়া বিভিন্ন গবেষকের প্রবন্ধসমূহ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ,
বোয়ালখালী হাজী মোঃ নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।