বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ : গন্তব্যের আরাধ্য প্ররোহ

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | মঙ্গলবার , ৩ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ


চলমান বছরের প্রায় পুরোটা সময় করোনা অতিমারির ভয়াবহতায় ক্ষত-বিক্ষত বিশ্ব ইতিমধ্যেই আনুমানিক ১১ লাখ ৬৬ হাজার প্রাণসংহার এবং ৪ কোটি ৪০ লাখ সংক্রমণ আক্রান্তের দুঃসহ দৃশপট অবলোকন করেছে। দ্বিতীয় তরঙ্গের পূর্বাভাস নতুন করে বিশ্ববাসীকে অজানা আশঙ্কা-আতঙ্কে নিরন্তর ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে। করোনা মুক্তির সঠিক কোন পন্থা এবং এর চৌহদ্দীবিহীন প্রসারমানতা প্রতিরোধে কার্যকর কর্মকৌশল এখনো বহুলাংশে অনাবিষ্কৃত। কোভিড-১৯ থেকে পরিত্রাণের প্রায়োগিক দৃষ্টান্ত স্থাপনে বিশ্বের অন্যতম সভ্য ও উন্নত দেশ জাপানের অবদান অগ্রগণ্য। ২৭. ১০. ২০২০ পর্যন্ত জাপানে আক্রান্ত-মৃত্যু-রোগমুক্তির সংখ্যা হচ্ছে যথাক্রমে ৯৭ হাজার ৭৪ জন-১ হাজার ৭ শত ১৮ জন-৮৯ হাজার ৭ শত ৯ জন। জাপানের আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা-সহনীয় লকডাউন-কর্পোরেট কালচার একদিকে অর্থনীতিকে সচল এবং অন্যদিকে করোনা জয়ের নিরলস উদ্যোগ বিশ্বের অন্য দেশের জন্য অত্যুজ্জ্বল শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয় অভিজ্ঞতার সঞ্চার করেছে।
একই ধারাবাহিকতায় আয়তনে অতি ক্ষুদ্র বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ জাপানের এই সাফল্য অনুসরণ এবং সকল ভয়কে জয় করে নবতর উদ্দীপনায় অদম্য অগ্রগতিতে অব্যাহত অভিযাত্রাকে এগিয়ে নেবেই – দৃঢ়ভাবে তা বিশ্বাস করা যায়। অতিসম্প্রতি কুৎসিত-পাপিষ্ট-কদর্য চরিত্রের অনুপ্রবেশকারী-অতীতের অবৈধ ও অনৈতিক স্বৈরাচারী সেনা শাসকদের সেবা দাস-দাসীদের নানা অপকৌশল অবলম্বনে শিক্ষা-উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ-পদবি দখল করে দেশকে অকার্যকর ও ধ্বংসের তলানীতে পৌঁছানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। জনশ্রুতি মতে অযোগ্য-অপদার্থ-মেধাশূন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এসব ব্যক্তিবর্গ অন্ধকারের শক্তির গোপন আঁতাতে বাহিনীভিত্তিক কূটচাল ও দেশের সম্পদ লুটপাটে ব্যতিব্যস্ত রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় ঋদ্ধ পরীক্ষিত-ত্যাগী-সৎ-নির্লোভ-নির্মোহ-দেশপ্রেমিক বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে কোণঠাসা করে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কথিত গণমাধ্যম-সামাজিক যোগাযোগের নিকৃষ্ট আশ্রয়ে চরিত্রহনন-হামলা-মামলা-বিতর্কিত করার হীন পন্থায় অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার অপতৎপরতায় খুবই সক্রিয় রয়েছে।
নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও দ্রব্যাদির পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও সিন্ডিকেটেড ঘৃণ্য কারসাজিতে সাধারণ-নিম্ন মধ্যবিত্ত-গরীব জনগণকে চরম দুর্দশা-দুর্ভোগের শিকারে পরিণত করছে। বর্তমান সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্রষ্টার অপার কৃপায় সকল ক্ষেত্রে তাদের অশুভ চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে সকল উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে থাকার অভূতপূর্ব স্বাক্ষর রেখে চলেছে। বিশ্বময় করোনার বিপর্যস্ততা অবজ্ঞায় প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের নিরলস পরিশ্রমে প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে। আউশ-আমনের বাম্পার ফলনে প্রতীয়মান হয়েছে বাংলার কৃষক ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং বন্যা-অতিবৃষ্টি-ভূমিধস-নদীভাঙনের কারণে ফসলহানির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে প্রায় দেড়কোটির অধিক মেট্রিক টন চাল উৎপাদন নিশ্চিত করেছে। পর্যাপ্ত তৈরি পোশাক শিল্পের কার্যাদেশ, নতুন অর্থনৈতিক জোনসহ বিভিন্ন কর্মসংস্থান উপযোগী স্থাপনা-মিল কারখানা দ্রুততর সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে জরুরি ও সময়োপযোগী আহবান অপরিমেয় চেতনায় আপামর দেশবাসীকে উদ্ভাসিত করছে।
মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী সময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্রকে যথার্থ অর্থে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী করার লক্ষে তাঁর অমীয় ভাষণে বর্ণিত রূপকল্প বাস্তবায়নে জাতি দৃঢ় বদ্ধপরিকর। আমাদের সকলেরই জানা আছে যে, ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির পদে ইস্তফা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তাঁর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনার মূলমন্ত্র ছিল শোষণমুক্ত জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এরই আলোকে ১৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ অক্ষুণ্ন রেখে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ঠিক পরের দিন রমনা রেসকোর্স ময়দানকে সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে নামাকরণের ঘোষণা এবং সরকারি আদেশে মদ, জুয়া, হাউজিসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন।
১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের হাইকোর্ট অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে হাইকোর্ট গঠন করেন। দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ২১ জানুয়ারি ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেন। ২৪ জানুয়ারি পাক-সামরিক জান্তাদের সহযোগী হয়ে এদেশে যারা মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী অপরাধকর্মে জড়িত বা দালালি করেছে, তাদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ৩০ এবং ৩১ জানুয়ারি মুক্তি ও মুজিব বাহিনীর সকল সদস্যবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর নিকট তাঁদের রক্ষিত অস্ত্রসমর্পণ করে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত দেশের সকল শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণের ঘোষণা দেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শোষণমুক্ত সোনার বাংলা কায়েমই আমাদের লক্ষ্য’।
বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনন্দিত গণতন্ত্রের ভারতকন্যা প্রয়াত শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে ঢাকায় আসেন এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২৫ বছরের জন্য শান্তি, সহযোগিতা ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৬ মার্চ দেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালন এবং সকল ব্যাংক, বীমা ও বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ঘোষণা করা হয়। ৮ মে সারা দেশে কবিগুরুর জন্মদিন যথাযথ মর্যাদায় পালন এবং ২৪ মে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারকে একটি ভবন ও রাষ্ট্রীয় ভাতা মঞ্জুর করে ২৫ মে এই বিদ্‌্েরাহী কবির উপস্থিতিতে অত্যন্ত আড়ম্বর পরিবেশে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়।
স্বাধীনতাকে পরিপূর্ণভাবে অর্থবহ করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। ৭ মার্চের নির্বাচন যাতে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, সুন্দর এবং রাজনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সকল দলের অংশগ্রহণে যথার্থ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা যায় তার জন্য ১৯৭৩ সালের ১০ জানুয়ারি গণভবনে মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রদত্ত ভাষণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন।বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমার দেশ চলবে। এটা যে শুধু আমার কথা তা নয়। যে শাসনতন্ত্র আমরা দিয়েছি সে শাসনতন্ত্রে সেটা প্রত্যেক অক্ষরে অক্ষরে গ্রহণ করা হয়েছে। … এটা শাসনতন্ত্রের মূলনীতি। যে শৃঙ্খলাকে ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র দিয়েছি যার জন্য আমরা স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছি এতো শহীদ হয়েছে, এতো রক্ত দিয়েছি এটা মিথ্যা হয়ে যাবে যদি আমরা আমাদের আদর্শ এবং মূলনীতি থেকে দূরে সরে যাই।’
১৯৭৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আগামীকাল ষোলই ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় দিবস। আরও স্পষ্ট কথা বিজয় দিবস। লাখো শহীদের রক্তমাখা এই দিন। লাখো মা-বোনের অশ্রুভেজা এই দিন। আবার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্ন ও পরম আকাঙ্ক্ষার এই দিন। এইদিন আমরা পরাধীনতার শিকল ভেঙে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সোনার বাংলার মানুষ বিদেশি শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি পেয়েছে। এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে বড় পবিত্র, বড় বেশি গৌরব ও আবেগমণ্ডিত। এই দিন আমরা শ্রদ্ধা ও শোকের সঙ্গে স্মরণ করি আমাদের স্বাধীনতা- সংগ্রামীদের, আবার এই দিন আমরা আনন্দ উৎসব করি, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাফল্যের জন্যে। এই দিন এক যুদ্ধ শেষ আর এক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ১৯৭১ সালের ষোলই ডিসেম্বর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি। এই একই দিনে আমাদের দেশ গড়ার সংগ্রাম শুরু। স্বাধীনতা সংগ্রামের চাইতেও দেশ গড়া বেশি কঠিন। দেশ গড়ার সংগ্রামে আরো বেশি আত্মত্যাগ, আরও বেশি ধৈর্য, আরও বেশি পরিশ্রম দরকার।’
বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে বহুবার উচ্চারিত হয়েছে – স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর স্বাধীনতা রক্ষা করা তেমন কষ্টকর। ত্রিশ লক্ষ শহীদানের মা, স্বামী, বিধবা বোনের কান্না এখনো বাংলাদেশকে প্রতিমুহূর্তে কাঁদাচ্ছে। তাঁরা জীবন বিসর্জন দিয়েছিল বাংলার মানুষকে শুধু স্বাধীন করার জন্য নয়, স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে যেন সকল মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। দু’বেলা পেট ভরে খেতে পারে। শহীদানের আত্মা শান্তি পাবে না যদি না দেশের সকল মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে না পারে। বঙ্গবন্ধু আরোও বলেন, ‘আমি চাই সোনার বাংলা, আমার সোনার মানুষ। সোনার মানুষ যেন সোনার বাংলায় পয়দা হয়। সোনার মানুষ না হলে সোনার বাংলা আমি গড়তে পারবো না। আমার স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যাবে। ………. ক্ষমতার মোহে যেন মানুষ পাগল না হয়ে যায়। মানুষকে যেন মানুষ ভালবাসে এবং মানুষের ভালবাসার মতো অতো বড় জিনিস আর দুনিয়ায় কিছুই হয় না’ (ভাষণ ১৩/০২/১৯৭৩, সুনামগঞ্জ)।
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা সৃষ্টিতে দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রামে জনগণকে অবতীর্ণ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন বিভিন্ন পর্যায়ে। কেন যে মানুষ অমানুষ হয়ে যায়, এতো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশের অনেকের কেন চরিত্রের পরিবর্তন হয় না এবং ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারী আর মুনাফাখোর কীভাবে বাংলাদেশের দুঃখি মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে তার বিশদ বক্তব্য সর্বত্রই জোরালো কন্ঠে উপস্থাপন করেছেন। কীভাবে গুটিকয়েক চোরাকারবারী, মুনাফাখোর ও ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে পাচার করে, জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়, খাবার জিনিস গুদামে মজুদ করে মানুষকে না খাইয়ে মারে – এ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি এসব অপশক্তিকে উৎখাত করার আহবান জানান।
চোরের শক্তি বেশি না ঈমানদারের শক্তি বেশি, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে তাঁর মত জনগণকেও উজ্জীবিত হওয়ার উদাত্ত আহবান জানিয়ে বলেন, ‘যদি পঁচিশ বছর পাকিস্তানী জালেমদের বিরুদ্ধে লড়তে পারি, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ থেকে আরম্ভ করে গোলাম মোহাম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, আইয়ুব খান আর ইয়াহিয়া খান পর্যন্ত সবার সাথে বুক টান করে সংগ্রাম করতে পারি, ৩০ লক্ষ লোকের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি, তাহলে দুর্নীতি, ঘুষখোর, মুনাফাখোরি আর চোরাচালানও নিশ্চয়ই নির্মূল করতে পারবো। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, তোমরাও প্রতিজ্ঞা করো। বাংলাদেশের জনগণ প্রতিজ্ঞা করুক। আমার আর সহ্য করবার শক্তি নেই।’ (ভাষণ ১১/০১/১৯৭৫, কুমিল্লা)
গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে মানুষকে শুধু সামাজিক জীব হিসেবে নয়, রাজনীতিক জীব হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। সমাজকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সেবা প্রদান এবং মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রেখে রাষ্ট্র ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অর্জনের মাধ্যমে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের যে নীতি ও আদর্শ, তারই সাধারণ নাম হচ্ছে সুষ্ঠু বা সুস্থ রাজনীতি।
এ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নির্দেশনা একটি জাতিকে যেমন দান করে সামগ্রিক উন্নয়ন রোডম্যাপ বা রূপকল্প, তেমনি বিপরীতমুখী বা সমাজ বিধ্বংসী রাজনীতিকে পরিচর্যার মাধ্যমে যে কোন সমাজকে করতে পারে সুদূরপ্রসারী বিপন্ন ও বিপর্যস্ত। যে কোন জাতি-রাষ্ট্রের আত্ননির্ভরশীল স্বয়ম্বর রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের অঙ্গীকার রাজনীতিক দূরদর্শীতার পরিচয় বহন করে। ফরাসী বিপ্লবের দর্শন তথা সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার চিরায়ত অনুপ্রেরণা পরবর্তীতে সকল স্বাধীনতাকামী জাতিগোষ্ঠীর মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তা কিন্তু শুধুমাত্র স্বাধীন ভৌগোলিক ভূ-খণ্ডের স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ভিন্নমাত্রায় তা ছিল জাতি-রাষ্ট্রের সকল জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়ন অর্থাৎ অর্থবহ স্বাধীনতার মৌলিক সূচক-নিয়ামক গুলোকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করে পরিপূর্ণ জীবনযাত্রার মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
উপরোল্লেখিত ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণে যেসব ‘ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারী আর মুনাফাখোরদের’ চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন; তারা এবং তাদের বংশধরদের চরিত্রের কুৎসিত বহিঃপ্রকাশে ন্যূনতম ব্যতিক্রম বা পরিবর্তন সূচিত হয়নি। অধিকন্তু নতুন নতুন নষ্ট পন্থা এবং কৌশলে দেশকে অস্থিতিশীল করার কুচক্রী কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছে। এদের সমূলে নির্মূল করে উন্নয়ন-অনুন্নয়নের অবস্থান নির্ধারণে বিবেচ্য উপাদানসমূহকে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় না আনা হলে স্বাধীনতার সার্থকতা অসারে পরিণত হবে। বিশ্বকবি রবীঠাকুরের ‘হতভাগ্যের গান’র কয়েকটি পংক্তি উপস্থাপনে নিবন্ধের ইতি টানতে চাই – ‘কিসের তরে অশ্রু ঝরে, কিসের লাগি দীর্ঘশ্বাস ?/ হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।/ রিক্ত যারা সর্বহারা সর্বজয়ী বিশ্বে তারা,/ গর্বময়ী ভাগ্যদেবীর নয়কো তারা ক্রীতদাস।/ হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস ॥’
লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাতীয় চার নেতার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
পরবর্তী নিবন্ধরাউজান পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডে মতবিনিময়