বঙ্গবন্ধুর পাগল ইসহাক মিঞা

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | রবিবার , ২৫ জুলাই, ২০২১ at ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ


ইসহাক মিঞা আওয়ামী লীগের প্রাচীন ধারার একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, যিনি প্রায় সবার শেষে প্রয়াত হন। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই যখন তাঁর ৮৬ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ওপর যবনিকা নেমে আসে, তখন তাঁর সমসাময়িক প্রায় সব রাজনীতিবিদই অস্তাচলে চলে গেছেন। তাঁর নেতা ছিলেন এম এ আজিজ; জহুর আহমদ চৌধুরীও তাঁর নেতৃপর্যায়ের মানুষ। এম আর সিদ্দিকী, আমীর হোসেন দোভাষ, শেখ মোজাফফর আহমদ, হান্নান সাহেব, মজিদ মিঞা, আবদুল্লাহ আল হারুন, মানিক চৌধুরী, মান্নান ভাই, ইদ্রিস মিয়া, সিরাজ মিয়া, মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী, মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী, এ কে এম আবদুল মন্নান, চৌধুরী এন জি মাহমুদ কামাল, তারেক, গণি, ডা. আনোয়ার হোসেন- এই সব নেতা, যাঁদের সঙ্গে তিনি রাজনীতি করতেন এবং অনেক আন্দোলন- সংগ্রামের ইতিহাস সৃষ্টি করে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ঝড় তুলেছিলেন, একে একে তাঁদের জীবন প্রদীপ নির্বাপিত হয়ে গেছে।
কিন্তু ইসহাক মিঞা ছিলেন, ফেলে আসা পথের দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে এবং স্মৃতির জাবর কেটে। একদিন তিনিও প্রভুর ডাক শুনতে পেলেন, তখন আর সময় থাকে না, তাঁরও সময় ছিলো না। সাততাড়াতাড়ি তাঁর স্রষ্টার সন্নিধানে চলে গেলেন।
ইসহাক মিঞা চট্টল ভূমিপুত্র। চট্টলামাতা তাঁর এই প্রিয় সন্তানটিকে এমনভাবে গড়ে পিঠে সৃষ্টি করেছিলেন যে, তাঁর দেহ সৌষ্টবের মধ্যে চট্টগ্রাম এমন ছাপ মেরে দিয়েছিল যে, তাঁকে দেখলে চট্টগ্রাম ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যেত না।
এমন খাঁটি চাটগাঁইয়া রাজনীতিবিদ এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সম্ভবত মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন এই ধারার শেষ রাজনীতিবিদ। তবে মেয়র হওয়ার পর থেকে তাঁর মধ্যে পরিশীলিত হওয়ার একটা সচেতন প্রয়াস লক্ষণ করা যেত, যেটা তাঁর চাটঁগাইয়া চরিত্রের মধ্যে মিলতো না।
ইসহাক মিঞার জীবনে ও রাজনীতিতে কোন অসঙ্গতি ছিলো না। তাঁর চরিত্রে কোন ভন্ডামি ছিলো না। তিনি যা’ বিশ্বাস করতেন, তাঁর জীবনাচরণেও তার প্রতিফলন ঘটতো।
তিনি পার্লামেন্টে দু’বার আগ্রাবাদ, ডবলমুরিং, হালিশহর, পতেঙ্গা, পাহাড়তলী এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তিনি জনপ্রতিনিধিত্ব বা জনসেবার পাঠ গ্রহণ করেছিলেন স্থানীয় পর্যায় থেকে। তিনি সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী (কপ) হিসেবে আগ্রাবাদ ওয়ার্ড থেকে ইউপি সদস্য (এমইউসি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় চট্টগ্রাম পৌরসভার দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। আগ্রাবাদ এমন একটি ওয়ার্ড, যা এক সময় ছিলো কিছু ছাড়া ছাড়া বসতির সমষ্টি। কিছু বৃত্তিমূলক বা কৌলিক মানুষের কলোনি যেমন পানওয়ালা পাড়া, সুপারিপাড়া, হাজি পাড়া, বেপারী পাড়া, মুহুরী পাড়া, মিস্ত্রি পাড়া ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছিলো আগ্রাবাদ ইউনিয়ন। যখন গোটা আগ্রাবাদ ছিলো একটি ইউনিয়ন, তখন মাঝখানে ছিলো বিশাল বিল, ধানী জমি- চাষাবাদের জন্য যেখানে জোড়ায় জোড়ায় হালচাষের বলদ, মহিষ দাপিয়ে বেড়াতো। দক্ষিণ পাশে ডাকাতিয়া বিল। আক্ষরিক অর্থেই সেখানে ডাকাতি হতো। ইসহাক মিঞা যখন এই এলাকায় জনপ্রতিনিধি হলেন, তখন তিনি এর মধ্যে সভ্য জীবনের বুনিয়াদ গড়ে তুললেন।
নিম্ন পর্যায় থেকে স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতি করার কারণে জনগনের প্রতি তিনি একটা দায়বদ্ধতা অনুভব করতেন। এলাকার উন্নয়ন, সমস্যার সমাধান, জনগনের অভাব-অভিযোগ মোচনে তিনি সব সময় তৎপর থাকতেন।
একটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। ষাটের দশকের কোন এক সময়, ইসহাক মিঞা তখন দক্ষিণ আগ্রাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। একদিন প্রবল বৃষ্টিতে এখন সেখানে লাকী প্লাজা তার সামনে ইসহাক মিঞার বাড়িতে যাওয়ার পথে একটি বড় নালা ও কালভাট ছিলো। বৃষ্টির তোড়ে কালভাট ভেসে যায়। ফলে রাস্তায় পানি উঠে যায়। জনগণ ইসহাক মিঞার কাছে প্রতিকার প্রার্থনা করলে তিনি সিডিএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন। আসফউদ্দৌলা সেখানে এসে আমলাসুলভ উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন এবং ইংরেজি বুলি কপচান যা’ না হলে হয়তো সিএসপির জ্ঞানের বহর প্রমান হতো না বলে তিনি মনে করেছিলেন। ইসহাক মিঞা রেগে কাঁই। তিনি আনন্দীপুরের (মগপাড়া’র বদিউল আলম মুন্সীর পুত্র আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হারিসকে ফোন করে বলেন, হারিস,তুমি তাড়াতাড়ি আমাদের বাড়ির সামনে এসো। হারিসদা আসার পর ইসহাক মিঞা তাকে বলেছিলেন, হারিস, এই সিডিএ চেয়ারম্যানকে একটু ইংরেজিতে বকে দাওতো।
হারিসদা ইংরেজিতে কথাবার্তায় পাকা ছিলেন। তিনি সিডিএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে ইংরেজিতে ইসহাক মিঞার বক্তব্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আসফদ্দৌলা নজরুলের গানের কিংবদন্তী শিল্পী ফিরোজা বেগমের ভাই। তিনি আরো কয়েক বছর চট্টগ্রামে ছিলেন। যতদিন ছিলেন ততদিন ইসহাক মিঞাকে সিডিএ তে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। তাঁর সমস্যার সমাধান করে দিতেন। এটার কারণ হলো আসফদ্দৌলা বুঝতে পেরেছিলেন ইসহাক মিঞা একজন প্রকৃত জনদরদী ও দেশপ্রেমিক মানুষ।
ইসহাক মিঞার চরিত্রের আর যে বৈশিষ্ট্যটি আমি লক্ষ্য করেছি, সেটি হলো তাঁর বেপরোয়া স্বভাব। কাউকে পরোয়া করে, ভয় করে, সংকোচ করে সত্য কথা বলতে তিনি কখনো দ্বিধান্দ্বিত হননি। কেউ অন্যায় করে তাঁর কাছে পার পাবার কোন জো ছিলো না। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী দুর্দান্ত সাহসী ছিলেন ইসহাক মিঞা। ইসহাক মিঞা ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১ মে উত্তর আগ্রাবাদ হাজি পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জনাব আলী, মাতা তামিজা খাতুন। ইসহাক মিঞা ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
বঙ্গবন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠতা : ইসহাক মিঞার রাজনৈতিক জীবনের শিক্ষা গুরু ছিল চট্টগ্রাম শহরের কিংবদন্তি নেতা এবং পরম শ্রদ্ধেয় বড় ভাই মরহুম এম এ আজিজ মরহুম ও জহুর আহমদ চৌধুরী। বলতে গেলে তাঁদের থেকেই তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছে। রাজনৈতিক যোগ্যতার বলে এই দুই কিংবদন্তি নেতার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। তাঁদের সংস্পর্শে থেকে বঙ্গবন্ধুর সাথে বহুবার সাক্ষাতের সুযোগ হয় তাঁর। ১৯৫৩ সালে প্রবীণ রাজনীতিবিদ মরহুম এম এ আজিজ, এন জি মোঃ কামাল, তারেক আহাম্মদ সহ বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল।
পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম শহরে আসেন। সেই সময় ইসহাক মিঞার ব্যক্তিগত জিপ গাড়ি করে বঙ্গবন্ধু, এম এ আজিজ, এন জি মোঃ কামাল, তারেক আহমদ চৌধুরী, ইসহাক মিঞা, শেখ মোশারফ হোসেন, আবুল কালাম, এম এ গনি, ফজলুল হক মাইজভান্ডার শরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যান। যাত্রা পথে বঙ্গবন্ধু সবাইকে দেশ উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যা কেউ ভুলতে পারেন নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগে মনোনয়ন বন্টনের সময় তৎকালীন চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে বহু নেতা প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজ দায়িত্বে এবং নিজ কণ্ঠে পার্লামেন্টারি বোর্ডে বলেন- চট্টগ্রাম-৮ আসনের একটি মনোনয়ন আমি ইসহাককে দিলাম, বাকীগুলো তোমরা দিয়ে দিও। বঙ্গবন্ধু নিজ দায়িত্বে ইসহাক মিঞাকে মনোনয়ন দেওয়াটা ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পরে বঙ্গবন্ধু নেতাকর্মী নিয়ে পুনরায় চট্টগ্রাম আসেন। তাদের মধ্যে ছিলেন- জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দিন আহম্মেদ, এম মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান সহ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। সেই দিন বঙ্গবন্ধু ও সকল নেতৃবন্দ ইসহাক মিঞার বাড়িতে দুপুরের খাবার খান। তখন চট্টগ্রাম শহরের সব আসনগুলোর মধ্যে তৎকালীন চট্টগ্রাম ৮ আসন (বন্দর-পতেঙ্গা, ডবলমুরিং) আসনটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই আসনটি থেকে ইসহাক মিঞাকে বঙ্গবন্ধু নিজে মনোনয়ন দেন এবং এই আসন থেকে তিনি বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তাই পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সাথে যখনই ইসহাক মিঞার সাক্ষাতের সুযোগ হতো তখনই তিনি তাকে ঠাট্টা করে বলতেন- “ইসহাক তোর ভিয়েতনামের খবর কি?” অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু বন্দর পতেঙ্গা নিয়ে তার এই আসনটিকে ভিয়েতনাম বলে ডাকতেন কারণ তখন ভিয়েতনামের মতোই আমার এই আসন বিভিন্ন রকম নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। তাই বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছ থেকে প্রায়শ এই সংসদীয় এলাকার জনগণের খোঁজ খবর নিতেন। চট্টগ্রাম শহরে বঙ্গবন্ধুর সফর মানে ছিল ইসহাক মিঞার কাছে এক খুশির দিন।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিসংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রফেসর আবদুল করিম: অনন্য মনীষা