সুন্দর, আকর্ষণীয় চেহারা, মাঠে–ময়দানে ঘুরে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা কিংবা আর্থিক সংগতি ইত্যাদি কোনো মানুষকে নেতৃত্বের আসনে আসীন করার জন্য একমাত্র যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। নেতৃত্ব পাওয়া, নেতৃত্ব দেওয়া এবং তা ধরে রেখে জনমানুষের মনে স্থায়ী আসন তৈরি করার জন্য ওপরের গুণাবলী ছাড়াও ব্যক্তিগত জীবনে নীতি–নৈতিকতা ও আদর্শের চর্চা অত্যন্ত জরুরি। শৈশব থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই নীতি–নৈতিকতা ও আদর্শের লালন এবং চর্চার মাধ্যমে তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চাইতে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাকে পেছনে ফেলে জনমানসে বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনকের আসনে স্থায়ীভাবে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক নানা ঘটনা বিশ্লেষণ করলে তাঁর নিজেকে এবং দলকে জনমনে প্রতিষ্ঠার পেছনে এই নীতি–নৈতিকতার প্রভাব কতখানি তা আমরা সহজে বুঝতে পারি।
শিশুকাল থেকেই আর্ত–পীড়িত–ক্ষুধার্ত মানুষের দুঃখ–দুর্দশা দেখে কষ্ট পেতেন বঙ্গবন্ধু। তাদের পাশে গিয়ে তাদের জন্য কিছু করতে পেরে স্বস্তি বোধ করতেন। ৪৩ এর দুর্ভিক্ষের সময় অসহায় মানুষের দুরবস্থা দেখে তা দূর করার জন্য লেখাপড়া ছেড়ে কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তার বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। তিনি লিখেছেন, ‘সেই বাংলাদেশের দুরবস্থা চোখে দেখেছি যে, মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবার জন্য কাড়াকাড়ি করছে। ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে মা কোথায় পালিয়ে গেছে। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রি করতে চেষ্টা করছে। কেউ কিনতেও রাজি হয় নাই। …এই সময় শহীদ সাহেব (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসায় এবং আরও অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খুললাম। দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোনোদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোনোদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম। আমার আরও কয়েকজন সহকর্মী ছিলেন। কলেজ জীবনেও ছাত্রদের বিপদে–আপদে সাহায্য করা, হোস্টেলে সিট না পেলে নিজের কক্ষে আশ্রয় দেওয়াকে নৈতিক দায়িত্ব মনে করতেন তিনি। তাঁর নিজের ভাষায়-‘কোন ছাত্রের কি অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার. আমাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকরা আমার কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালবাসত। হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট সাইদুর রহমান সাহেব জানতেন, আমার অনেক অতিথি আসত। বিভিন্ন জেলার ছাত্রনেতারা আসলে কোথায় রাখব, একজন না একজন ছাত্র আমার সিটে থাকতই। কারণ, সিট না পাওয়া পর্যন্ত আমার রুমই তাদের জন্য ফ্রি রুম।
মানুষের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে লাজ–লজ্জার ধার ধারতেন না তরুণ নেতা শেখ মুজিব। প্রয়োজনে ঠেলা গাড়ি ঠেলে অভাবীদের কাছে খাবার পৌঁছে দিতে দ্বিধা করতেন না তিনি। দর্ভিক্ষের দিনে বঙ্গবন্ধুর সেই ঠেলা গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা–এরকম,-হোস্টেলগুলিতে চাল, আটা ফুরিয়ে গিয়েছে। দোকান–পাঠ বন্ধ, লুট হয়ে যাবার ভয়ে। নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে গিয়ে পরামর্শ চাইলেন, কি করা যায়! শহীদ সাহেব বললেন, ‘নবাবজাদা নসরুল্লাহকে (ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহর ছোট ভাই) ভার দিয়েছি, তার সাথে দেখা কর’। বঙ্গবন্ধু তাঁর সাথীদের নিয়ে নবাবজাদা নসরুল্লাহর কাছে গেলে তিনি তাঁদের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘চাল এখানে রাখা হয়েছে, তোমরা নেবার বন্দোবস্ত কর। আমাদের কাছে গাড়ি নাই। মিলিটারি নিয়ে গিয়েছে প্রায় সমস্ত গাড়ি। তবে দেরি করলে পরে গাড়ির বন্দোবস্ত করা যাবে’। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু নূরুদ্দিন ও নূরুল হদা নামে তাঁর দুই সঙ্গী নিয়ে ঠেলাগাড়িতে চাল বোঝাই করে নিজেরা ঠেলে ঠেলে সেই চাল পৌঁছে দেন বেকার হোস্টেল ও ইলিয়ট হোস্টেলে।
মনুষ্যত্ব তথা মানবতা বোধের ওপর সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। মানুষের প্রতি অমানবিক কোনো আচরণ কিংবা অবহেলা দেখলে তিনি বিচলিত হয়ে পড়তেন। এ ধরণের আচরণ থেকে বিরত থাকার জন্য দলীয় কর্মী বা বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সাবধান করে দিতেন, আকুতি জানাতেন।
১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর পিজি হাসপাতালের রক্ত সংরক্ষণাগার ও নুতন মহিলা ওয়ার্ডের উদ্বোধন করতে গিয়ে দেওয়া বক্তৃতায় ফুটে উঠেছে তাঁর সেই আকুতি। তিনি বলেন, ‘পয়সা দিয়ে সবকিছু হয় না, পয়সার সাথে সাথে আরেকটা জিনিস দরকার। সেটা হলো মানবতা বোধ। আমরা যেন মানবতাবোধ হারিয়ে ফেলেছি। পয়সা কোনো জায়গায় কম দেওয়া হচ্ছে না। ভিক্ষা করে হোক, বন্ধু রাষ্ট্রদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে হোক, ব্যাংকের থেকে সাহায্য নিয়ে হোক, গ্র্যান্ট নিয়ে হোক, পয়সা এনে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জাতীয় চরিত্র আমাদের নষ্ট হয়ে গেছে। কুমিল্লার একটি সভায় এমন বক্তব্যের পুনরুল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শেখ মুজিবর রহমানকে বেটে খাওয়া যাবে, বাংলাদেশ সোনার বাংলা করতে পারবেন না, যদি সোনার মানুষ গড়তে না পারেন।
ওই ভাষণেই বঙ্গবন্ধু মানুষের প্রতি সহানুভুতিশীল আচরণ করা এবং সেবার ক্ষেত্রে ধনী–গরিব ভেদাভেদ না করার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি ওই দুঃখী মানুষের নেতা। ওরা আমাকে নেতা বানিয়েছে, বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের সাথে আমি থাকব।’ বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সাদা কাপড় পরা ভদ্রলোকেরা খালি প্রমোশন চায়। এ ছাড়া, বিশেষ কোনো কাজ করতে চায় না। আমি দেখেছি যে, মেডিকেল কলেজের সামনে দুঃখী নেংটা পড়ে আছে–তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করে না। আর বড় গাড়ি করে যখন কেউ হাজির হয়, তখন সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসেন। আপনারা ডাক্তার, আপনাদের মন হতে হবে অনেক উদার, আপনাদের মন হতে হবে সেবার। আপনাদের কাছে ছোট বড় থাকবে না। আপনাদের কাছে থাকবে রোগ। কার রোগ বেশি কার রোগ কম। তা হলেই তো সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে এবং আপনারা মানুষের সহযোগিতা পাবেন।’ ছাত্রদেরও বঙ্গবন্ধু সব সময় নৈতিক আদর্শে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। আত্মশুদ্ধি, আত্মসমালোচনা ও মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, আত্মবিশ্লেষণ, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে না পারলে অন্যকে বলার কোনো অধিকার নেই। তোমরা আত্মসংযম অভ্যাস কর, আত্মসমালোচনা কর, আত্মশুদ্ধি করো। তারপর পথে নাম। মানুষ শুনবে, দেখবে, শিখবে, শ্রদ্ধা করবে ভালোবাসবে। মানুষও উৎসাহী হয়ে তোমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে। কেউ কোনোদিন বল প্রয়োগে ভাল কিছু করতে পারে নাই।’
স্বাধীনতার পর নকল প্রবণতার মতো অনৈতিক কাজ সামাজিক ব্যাধির মত বেড়ে যায়। ছাত্রদের নকল প্রবণতার ব্যাপারে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দুঃখের কথা এই যে, পুলিশ দিয়ে ছাত্রদের পরীক্ষার নকল বন্ধ করতে হয়। একথা কার কাছে বলব? দোহাই আল্লাহর, নকল বন্ধ করার জন্য আর যেন আমার পুলিশ দিতে না হয়। তোমরা নিজেরাই মিলে মিশে নকল বন্ধ কর। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এক সাথে হয়ে যেমন সংগ্রাম পরিষদ করেছ, তেমনি তোমরা মিলে মিশে এই সমস্যার সুরাহ কর। তোমাদের আমি সাহায্য করব।’
বঙ্গবন্ধু নিজে যেমন লোভী ছিলেন না তেমনি দলের ভেতর লোভী লুটেরাদের চরম ঘৃণা করতেন। ১৮ জানুয়ারির ভাষণেই তিনি আওয়ামী লীগে লুটপাটকারীদের উৎখাতের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘কোন দিন স্বার্থে অন্ধ হয়ে তোমাদের ডাক দেই নাই। কোন দিন কোন লোভের বশবর্তী হয়ে কোন শয়তানের কাছে মাথা নত করি নাই। কোন দিন ফাঁসির কাষ্ঠে বসেও বাংলার মানুষের সঙ্গে বেঈমানী করি নাই।’ আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দুই চারটা–পাঁচটা লোক অন্যায় করে, যার জন্য এতো বড় প্রতিষ্ঠান যে প্রতিষ্ঠান ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, যে প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা এনেছে, যে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ কর্মী জীবন দিয়েছে যে প্রতিষ্ঠান ২৫ বছর পর্যন্ত ঐতিহাসিক সংগ্রাম করেছে তার বদনাম হতে দেওয়া চলে না।’ একজন মুসলমান হিসেবে বঙ্গবন্ধু নিজে ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ ছিল বরাবরই সোচ্চার। তিনি বলেন, রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টিকারীরা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালবাসে সে কোনো দিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। দলীয় নেতা–কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনারা যাঁরা এখানে মুসলমান আছেন, তাঁরা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন তিনি রাব্বুল আলামীন–রাব্বুল মুসলেমীন নন। হিন্দু হোক, খ্্রীষ্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক সমস্ত মানুষ তার কাছে সমান।
স্বাধীন দেশে কালোবাজারী, ভেজাল সৃষ্টিকারী ও ঘুষখোরদের তৎপরতার খবর তিনি রাখতেন এবং এতে তথাকথিত শিক্ষিত লোকের জড়িত থাকার কথা জেনে তিনি খুবই দুঃখ পেতেন। এমন অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে নেতা–কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। বঙ্গবন্ধু সত্যিই বলেছেন, বাংলার কৃষক, বাংলার দুঃখী মানুষ এরা কিন্তু অসৎ নয়। শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আপনারা রাগ করবেন না। ব্ল্যাকমার্কেটিং কারা করে? যাদের পেটের মধ্যে দুই কলম বিদ্যা হয়েছে তারাই ব্ল্যাকমার্কেটিং করে। স্মাগলিং কারা করে? যারা বেশী লেখা–পড়া করছে তারা বেশী করে। হাইজ্যাকিং কারা করে? যারা বেশী লেখা–পড়া শিখছে তারাই করে। ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলিং তারাই করে। বিদেশে টাকা রাখে তারাই। আমরা যারা শিক্ষিত, আমরা যারা বুদ্ধিমান, ঔষধের মধ্যে ভেজাল দিয়ে বিষাক্ত করে মানুষকে খাওয়াই তারাই। নিশ্চয়ই গ্রামের লোক এসব পারে না। নিশ্চয় আমার কৃষক, ভাইরা পারে না। নিশ্চয় আমার শ্রমিক ভাইরা পারে না। পেটের মধ্যে যাদের বুদ্ধি বেশী আছে তারাই ব্ল্যাক–মার্কেটিয়ার। আর বিদেশী এজেন্ট কারা হয়। নিশ্চয়ই আমার কৃষক নয়, নিশ্চয়ই আমার শ্রমিক নয়। আমরা যারা লেখা–পড়া শিখি, গাড়ীতে চড়ি, বিদেশে যাবার পারি, বিদেশীদের সঙ্গে মিশতে পারি, ভাল স্যুট পরতে পারি তারাই বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে বিদেশের এজেন্ট হই।’
সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদেরও তাদের কাজ করতে গিয়ে জনগণ যাতে অত্যাচারিত না হয় এবং নিজেদের যাতে বদনাম না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার নির্দেশ দিতেন তিনি। ১৯৭৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নৌবাহিনী দিবসে চট্টগ্রামে জওয়ানদের প্রতি তিনি বলেন, ‘তোমরা যেখানেই যাও, কেউ যেন তোমাদের বদনাম করতে না পারে। কেউ যেন না বলতে পারে, তোমরা অত্যাচার করেছো।
তোমাদের কর্তব্য হবে, যখনই কোন কাজ করতে যাবে, মানুষের মুখের দিকে তাকাবে। দেখবে তার চেহারা হয়তো তোমাদের বাবার মতো, নয়তো ভাইয়ের মতো, নয়তো মা বা বোনের মতো। সকলেই তোমাদের ভাই, সকলেই তোমাদের আত্মীয়–স্বজন। আজকে দেশের যা কিছু তোমরা দেখো, সবই এই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের, বাংলাদেশের জনগণের টাকায় হয়েছে। তাই তাদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর সরকারের আমলে ঘুষ–দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অন্যায়ের কথা লুকিয়ে রাখার নীতিতে বিশ্বাস করতেন না। বরং এ ধরণের অন্যায় কাজের ব্যাপকতার কথা স্বীকার করে লুটেরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এক্ষেত্রেও জনমত তৈরির ওপর জোর দেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লায় সামরিক একাডেমিতে শিক্ষা সমাপণী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই। আমরা এত রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। তবু অনেকের চরিত্র পরিবর্তন হয়নি। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারী আর মুনাফাখোর বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বছর আমি তাদের কাছে অনুরোধ এবং আবেদন জানিয়েছি, তাদের হুমকি দিয়েছি। কিন্তু “চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী।”
একই সাথে বাহিনীর সদস্যদের উর্ধতন কর্র্তৃপক্ষের আদেশ নিষেধ মেনে চলার নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, ‘তোমরা যদি তাদের হুকুম না মানো, তোমাদের অধীনস্থ কেউ তোমাদের হুকুম মানবে না। এই জন্যই তোমাদের ওপরওয়ালার হুকুম মানতে হবে।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিজীবনে অনুসৃত নীতি–নৈতিকতা–আদর্শ এবং এ সম্পর্কে তাঁর উপর্যুক্ত মুল্যবান নির্দেশনাগুলো দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি, সমাজ, প্রশাসন ও রাষ্ট্রসহ সর্বস্তরে বর্তমানেও সমানভাবে অনুসরণযোগ্য। বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেই নীতি–আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে একটি সুখি সমৃদ্ধ অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে বার বার তাগাদা দিচ্ছেন। নিজেও পিতার মতো অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। দলমত নির্বিশেষে সবাই আন্তরিকভাবে এসব নীতি–আদর্শের চর্চা অব্যাহত রাখলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা কায়েম করে অচিরেই বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়া সম্ভব।
লেখক : গবেষক, সম্পাদক, ইতিহাসের খসড়া, ফেলো, বাংলা একাডেমি।