গণি ভাই’র জন্য দুঃখ হয়। এক সময় চট্টগ্রাম শহরের তুখোড় আওয়ামী লীগ নেতা তিনি; চট্টগ্রাম শহরে আওয়ামী লীগ যখন শৈশবে হামাগুড়ি দিচ্ছিলো সেই পঞ্চাশের দশকে, তখন গণি-কামাল-তারেক থ্রি মাস্কেটিয়ার্স বা ত্রিরত্নই আওয়ামী লীগের ‘বাওটা’ (পতাকা) উড়িয়ে শহরময় ঘুরে বেড়াতেন; হায় ত্রিরত্ন যে একে একে প্রস্থান করলেন চট্টগ্রামের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে, সেটা কেউ খেয়াল করলো না। কারো চোখের পাতা ভিজলো না, কারো বুক থেকে এক ফোটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো না। কারো মুখ থেকে শোনা গেল না বিলাপধ্বনি। কামাল, তারেক আগেই প্রস্থান করেছিলেন, লন্ডনপ্রবাসী হয়ে শিবরাত্রির সলতের মতো টিমটিম করে জ্বলছিলেন গণি ভাই।
এবার তিনিও শেষ যাত্রা করলেন। শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, মাননীয় মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং আমাদের তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সহ আরো কেউ কেউ তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন দেখলাম। সব পেপার পড়ার আমার সুযোগ নেই। দু’একটি দেখি, তাও দেখা হয়নি। আমি টেলিভিশনে দেখলাম তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশের সংবাদ। গণি ভাই সর্বইউরোপিয় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও উপদেষ্টা ছিলেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগেরও মুখ্য সংগঠক ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি একজন কমিউনিটি লিডার ছিলেন। গণি ভাই আমাকে বলেছেন, তিনি ৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর লন্ডনে গিয়ে সেখানেই ডেরা পেতে স্থায়ীভাবে থেকে যান।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ও তাঁর ভাই ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া গণি ভাই’র স্নেহধন্য ছিলেন। গণিভাই’র জীবনী সংকলনের জন্য বিদ্যুৎ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছেন বলে আমি শুনেছি। সেগুলি তিনি যদি আমাকে দেন, তাহলে আমি গণি ভাই’র ওপর আরেকটি সমৃদ্ধ লেখা তৈরি করে দিতে পারি।
তারিক-গণি-কামাল বঙ্গবন্ধুর ত্রিরত্নস্বরূপ ছিলেন। তাঁরা ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভক্ত। সোহরাওয়ার্দী সাহেব চট্টগ্রাম আসলে তিনবন্ধু তাঁর সঙ্গে থাকতেন। সোহরাওয়ার্দীর সূত্রে তাঁরা বঙ্গবন্ধুরও লোক হয়ে যান। তাঁরা চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্নের কর্মী।
তারিক সদরঘাটে থাকতেন। তিনি গণির চেয়ে বয়সে বড়। তাঁর পুরো নাম তারিক আহমদ চৌধুরী।
গণির পুরো নাম এম এ গণি। বহু বছর ধরে তিনি লন্ডনের বাসিন্দা। ১৯৬৯ সালে তিনি লন্ডনে চলে যান। ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’, এই প্রবাদের মতোই তিনিও লন্ডনে গিয়ে আওয়ামী লীগই করেন। এমএ গণি চট্টগ্রাম শহরের আদি বাসিন্দা। পাথরঘাটা নজু মিয়া লেনে তাঁর পৈত্রিক বাসভবন। তিনি অষ্টাদশ-ঊনিশ শতকের বিখ্যাত সরের জাহাজ ব্যবসায়ী শরীয়তুল্লাহ সওদাগরের বংশধর, প্রপৌত্র। তাঁর দাদা বদর রহিম সওদাগরও নামী ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি বঙিরহাটের মালিক ছিলেন বলে জনাব গণি আমাকে জানান। খাতুনগঞ্জের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছোবান সওদাগর ওরফে রাজা মিয়া সওদাগর তাঁর নানা। ছোবান সওদাগর তার বাড়ির সম্মুখে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যার নামকরণ হয়েছে ‘ছোবানিয়া মাদ্রাসা’।
ষাটের দশকের এমপি ইসলাম মিয়া রাজা মিয়া সওদাগরের জামাতা এবং জনাব গণির খালু। ইসলাম মিয়া মনসুরাবাদের বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী খান সাহেব আবদুল হাকিম মিয়ার পুত্র। জনাব গণির পিতা মোহাম্মদ মিয়া প্রথম মুসলিম ব্যবসায়ী, যিনি ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামে একটি পারফিউম ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর ফ্যাক্টরির নাম ছিলো ‘সুলতানিয়া পারফিউমারি ওয়ার্কস’; সেটাই হয়তো চট্টগ্রামের প্রথম পারফিউম ফ্যাক্টরি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় গণি ভাই সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন। তিন নেতাই তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রভাবে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি, এনজি মাহমুদ কামাল এবং তারিক আহমদ চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক ছিলেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী তোহফাতুন্নেছা আজিমের জন্য কাজ করেন। এম এ গণির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো ঢাকায় তিনচার বছর আগে। তখন তাঁর সঙ্গে ভালো করে কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। পঞ্চাশের দশকে তারিক-কামালের দোসর ছিলেন তিনি।
কামাল মানে চৌধুরী এন জি মাহমুদ কামাল। অভিজাত পরিষদের সন্তান তিনি। নজির আহমদ রোডের দক্ষিণ প্রান্তে তাঁর বাসভবন, উত্তর প্রান্তে তাঁর নানা হাতি কোম্পানি নামে খ্যাত আবদুল গণি সওদাগরের বাসভবন। খান বাহাদুর ফরিদ আহমদ চৌধুরী তাঁর মামা। পিতা আবদুল হালিম বিএ, বিএলও বিখ্যাত মানুষ, দিকপাল আইনজীবী। হাটহাজারী উপজেলার ছাদেকনগরের প্রখ্যাত জমিদার আহছানউল্লা চৌধুরী এবং হযরত আবদুল জলিল বা বালু শাহ তাঁর পূর্ব পুরুষ। আহছানউল্লাহ চৌধুরী চট্টগ্রাম জমিদার এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও ডেভেলপার সংস্থা ইকুইটির চেয়ারম্যান বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. মঈনুল ইসলাম মাহমুদ চৌধুরী এন জি মাহমুদ কামালের ভ্রাতুষ্পুত্র। তারেক-গণির সঙ্গে ওঠাবসা ছিলো তাঁর, সেই সূত্রে তিনজনের নাম একসূত্রে গাথা হয়ে যায়।
এন জি মাহমুদ কামালও শহর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্নের কর্মী। সম্ভবত তারেক-গণির আগে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি ডা. ছৈয়দুর রহমানের পর সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন, সম্ভবত ৬৪-৬৫ সালের দিকে। এন জি মাহমুদ কামাল ভালো লেখাপড়া জানতেন। কথায় কথায় ইংরেজি বুলি আওড়ানো তাঁর মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছিলো। কঠিন, অপ্রচলিত এবং ভারি ভারি ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করতেন। জহুর আহমদ চৌধুরী পরিহাসপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনি ঠাট্টা করে এনজি মাহমুদ কামালের নাম দিয়েছিলেন ‘বোম কামাল’। এন জি মাহমুদ কামাল সম্ভবত তারিক-গণি থেকে বয়সে জ্যেষ্ঠ ছিলেন।
তারিক-গণি-কামাল পঞ্চাশের দশকে শহরের চেনা মুখ এবং আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর নির্ভরযোগ্য কর্মী। বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম আসলে তাঁরা তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে বিরাজ করতেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব এবং বঙ্গবন্ধুর গাড়ির আগে তাঁরা ভলান্টিয়ারের মত থাকতেন। বঙ্গবন্ধু এই ত্রিরত্নকে খুবই আদর ও স্নেহ করতেন। তারাও বঙ্গবন্ধু-অন্ত-প্রাণ ছিলেন।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও সংস্কৃতি সংগঠক