১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় দিন। এই দিনটিতে জাতি অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়। পরবর্তীতে অন্ধকারের মধ্যেই অনেক বছর অতিবাহিত করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নোবেল জয়ী তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির নেতা ইউলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে। সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছেন। দ্য টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় বলা হয় সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে’।
১৫ আগষ্টের বিয়োগান্ত ঘটনার ইঙ্গিত ছিল মাস পাঁচেক আগেই। অবমুক্ত করা মার্কিন দলিল থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ২৩ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে তৈরী পাঁচটি কুটনৈতিক তার বার্তার শিরোনামেই ‘বাংলাদেশ, অভ্যুত্থানের গুজব’ কথাটি ছিল। কিন্তু ২০ মার্চে মিসরের আসওয়ানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানো তারবার্তাটি নানা কারণে ব্যতিক্রম। সেটির শিরোনামে ‘সম্ভাব্য অভ্যুত্থান’ বলা হয়েছে। তবে এসব তার বার্তার বিবরণ অবমুক্ত করার আগেই মুছে দেওয়া হয়েছে। তাই ভিতরে কী লেখা ছিল, তা কখনো জানা যাবে কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বিশ্বাসঘাতকতা, বেঈমানী এবং কৃতঘ্নতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঙালির রক্তের সাথে মিশে আছে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে মীরজাফর ও তার সহযোগীদের যুগের পর যুগ ঘৃণা করে আসছে ও করবে। পলাশীর আম্রকাননে যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল সেই স্বাধীনতার সূর্য আবার ১৯৭১ সালে লাভ করেছি। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকরা এর বিরোধিতা করে এবং মেনে নিতে পারেনি বলেই ১৯৭৫ এর হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ইতিহাসে জানা যায়, নেতাজি সুভাষ বসু, শেখ মুজিবুর রহমান ও নেলসন ম্যান্ডেলা তিনজনই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, দেখিয়েছিলেন। এক অদৃশ্য সূতায় একে অপরের সঙ্গে বাধাঁ। তাঁরা তিনজনই পরাধীন জাতির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা। শুধু নিজ নিজ দেশ বা জাতির নয়, পৃথিবীর যেখানেই নিপীড়িত মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন, এই তিন নেতা তাদের জন্য আশার প্রতীক। এই তিন মহান ব্যক্তি আত্মত্যাগের মাধ্যমে মুক্তি অর্জন করতে সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছেন। এই সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে আমাদের এই মহান অর্জনকে ধরে রাখতে শারীরিক ও মানসিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তবেই প্রকৃত মুক্তি আসবে। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ১৯৭১ সালে সবাই বঙ্গবন্ধুর কাজ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল। আগামী দিনেও তাঁর কর্মময় জীবন ও আদর্শ থেকে মানুষ প্রেরণা লাভ করবে। আজকের দিনে বঙ্গবন্ধুকে জানার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের বঙ্গবন্ধুকে জানা খুব বেশি প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু এমনই এক মানুষ ছিলেন, যার আত্মত্যাগের মাধ্যমে, বাংলাদেশ অর্জন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি অধ্যায় অতিক্রম করেছে। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপর একেবারে নির্ভরশীল দুইটি গ্রন্থ যথা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা’ এর নির্ভরশীল তথ্য উপাত্ত সঠিক ইতিহাস জানতে সাহায্য করবে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুলকে অতিক্রম করে তিনি এ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৭৩ সালের ৩০ মে তার লিখিত ডায়েরি পাঠের মাধ্যমে। তিনি লিখেছিলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়ে আমি ভাবি’। এতে বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। ঐ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে যে জীবনাদর্শন দিয়ে গেছেন ও আদর্শ রেখেছেন তা অমলিন। অমর হয়ে আছে তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উৎকর্ষতায়। আমাদের এককেন্দ্রিক নয়, সামষ্টিক চিন্তা মাথায় রাখতে হবে। সকলের জন্য কাজ করা এবং সকলকে সুখের অংশীদার করা প্রকৃত মানুষের কর্তব্য। একবিংশ শতাব্দীর তরুণ প্রজন্ম আগামী শতকের কাণ্ডারি। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামগ্রিক উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক মহানায়ক থেকে ইতিহাসের মহানায়ক। কালের প্রতিহিংসা, হানাহানি ও দলীয় কোন্দল বাদ দিয়ে মানবিক মূল্যবোধ ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে হবে। মহানায়ক থেকে কালোত্তীর্ণ মহান নেতা। রাজনৈতিক সামাজিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় তিনি বাঙালির বিবেক থেকে বিশ্ব বিবেকে পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের অংশ থেকে ইতিহাস প্রণেতা। অতঃপর সমগ্র ইতিহাস। ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে সৃষ্টি করেনি বঙ্গবন্ধু নিজেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তাই তিনি অমর হয়ে থাকবেন। নতুন প্রজন্মকে নিয়ে একটি সুন্দর দেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের সঠিক ইতিহাস জানা দরকার। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি একটি বড় উদাহরণ।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম