আমদের দেশে একুশে বইমেলা এখন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বইমেলা মানুষের আত্মার বন্ধু–যে আত্মার খোরাক জোগায় মনোরঞ্জনে সহায়তা করে। বই পাঠ মানুষের দুরন্ত নেশা। সে বই যখন মেলায় আগত হয় মানুষের হাতের নাগালে, তখন সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে শুধু বই আর বই। মানুষ তখন যেন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছুটে যায় বই মেলায়, তার সুধা আহরণে, রসাস্বাদনে। মানব সভ্যতার অন্যতম প্রাণসত্তা বইমেলা। স্বাধীন বাংলাদেশে ‘মুক্তধারা’ নিজ উদ্যোগে প্রথম বইমেলার আয়োজন করেছিল ১৯৭৫ সালে। এরপর বাংলা একাডেমি বইমেলার আয়োজন করে ১৯৭৮ সাল থেকে। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমির এই বইমেলার নাম দেওয়া হয় ‘একুশে বইমেলা’। চট্টগ্রামে মুসলিম ইনিস্টিউটশন চত্বরে, জিমনেসিয়াম চত্বরে বইমেলার আয়োজন করা হতো। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ‘সিআরবি’– তে বই মেলার চমৎকার আয়োজন করা হয়। বইমেলা এমন একটি সুন্দর ও সর্বজনীন মেলা, যেখানে সকল স্তরের মানুষের জন্য তার দুয়ার থাকে অবধারিতভাবে উন্মুক্ত।
শিশুরা যেমন বই হাতে নিয়ে মা বাবা–মাকে অনুরোধ করে বইটা কিনে দেবার জন্য, তেমনি প্রেমিক স্বামী ও তার স্ত্রীকে অবলীলায় দু’চারটি বই উপহার দিয়ে থাকে। প্রৌঢ়বয়সী সম্মানিত ব্যক্তিগণও মনের আনন্দে কালজয়ী লেখকদের কয়েকটি বই নিয়েই নেন।
বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলো থেকে দু–চারটা বই উপহার হিসেবেও হাতে চলে আসে। তাছাড়া স্টল ধারী প্রকাশকগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটা বিশেষ ছাড়ে বইগুলো ছাড়তে থাকেন। এসময় প্রকাশন সংস্থাগুলো বেশ ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করতে থাকে। প্রতিদিনই নিত্য নতুন বই মেলায় প্রকাশিত হয় নতুন–পুরাতন অনেক কবি–লেখকদের। বইমেলার কারণে প্রকাশকদের সাথে লেখকদের ও একটা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে যেমন লেখক–পাঠকের মাঝে গড়ে ওঠে। মূলত লেখক, প্রকাশক, পাঠক এই তিনের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত এই বইমেলা —এদেরই এক অবিস্মরণীয় মিলন মেলা।
প্রায় মাস ব্যাপী এ আয়োজনে দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়াও একধরনের নাগরিক আনন্দ। বই কিনি না কিনি হাতে বই নাড়াচাড়া করলেও হৃদয় পুলকিত হয়। এটা তো শুধু বই মেলাতেই সম্ভব। পড়ুয়াগণ সারা বছরের বই কালেকশন করে নেন। আবার দেখা যায় তরুণী দল ঝাঁক বেঁধে মেলার বিভিন্ন স্টলে ঘুরে বেড়াচ্ছে শাড়ি, চুড়ি পরে, মাথায় ফুল গুঁজে, চমৎকার দেখতে লাগে যেন রঙিন প্রজাপতি। আর এখন তো মোবাইলের যুগ। কোন বিশেষ স্টলে কোন প্রখ্যাত কবি, লেখক, শিশু সাহিত্যিক কিংবা গল্পকার থেকে থাকলে তো সোনায় সোহাগা। সেলফি, অটোগ্রাফ অথবা গ্রুপফটো তুলতে সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বইয়ের লেখক চোখের সামনে এর চেয়ে থ্রিলিং আর কী হতে পারে! আসলে এই বইমেলার আকর্ষণ দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। সকলের প্রাণের স্পন্দন যেন চারপাশে শোনা যায়। চলে আনন্দ– আড্ডা, চলে চা–পান, চলে খুনসুটি, চলে প্রাণের কথা। এভাবেই এগিয়ে যাবে বইমেলা। যতই দিন যাবে, মানুষ শৃঙ্খলিত হয়ে পড়বে ততই বই মেলার জনপ্রিয়তা চমৎকারভাবে বেড়ে যাবে। এই বইমেলার উন্মুক্ত পরিবেশে মানুষ খুঁজে পেতে চাইবে মুক্তির আস্বাদন। শুভকামনা বইমেলা।