‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণে নিহিত ছিল বাঙালির মুক্তির ডাক। সে ভাষণের ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ তিনি ঘোষণা করেন স্বাধীনতা। জাতির জনকের বজ্রকণ্ঠের সে ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের মর্যাদা পেয়েছে।
গতকাল সোমবার ছিল ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে চলছে বইমেলা। এদিন বইমেলা জুড়ে আলোচনার বিষয় ছিল বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ। বইমেলার মঞ্চেও আলোচনা হয়েছে ভাষণটির তাৎপর্য নিয়ে। লেখকের জন্য সংরক্ষিত স্থানেও আড্ডায় গুরুত্ব পেয়েছে তা।
গতকাল বইমেলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত ৭ মার্চের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। প্রধান আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শহীদুল আলমের সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে আলোচক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মো. জসিম উদ্দীন, সচিব খালেদ মাহমুদ, সাংবাদিক ওমর কায়সার। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বইমেলা কমিটির আহ্বায়ক কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ৭ মার্চের ভাষণের সূচারুভাবে ব্যবচ্ছেদ করলে এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিকটি সমান্তরালভাবে চোখে পড়ে। শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সে ভাষণটি দেননি। বাঙালি সেদিন তার মাধ্যমে, তাকে কেন্দ্র করে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল। তাই, তার প্রতিটি পদক্ষেপ ও বাণী ছিল বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার নিয়ন্ত্রক।
তিনি বলেন, ভাষণে মূলত চারটি দাবি তোলা হয়। মার্শাল ল প্রত্যাহার, সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। বঙ্গবন্ধু ‘দাবি পূরণের পরে আমরা ভেবে দেখবো অ্যাসেম্বলিতে বসব কিনা’, এ ধরনের কথা উচ্চারণ করে একদিকে আলোচনার পথ খোলা রাখলেন এবং ভাষণ পরবর্তী সৃষ্ট স্বায়ত্তশাসন দাবির আন্দোলনের দায়ভার থেকে নিজেকে এবং তার দলকে বাঁচিয়ে নিলেন। বিশ্ব দরবারে বঙ্গবন্ধু একজন উদারপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান।
তিনি আরও বলেন, ভাষণের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর অসামপ্রদায়িক চেতনার দিকটি খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর’ উক্তিতে। সরাসরি না বলেও তিনি বাঙালিদের বুঝিয়ে দিলেন তার মনের কথা। পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিরোধের নির্দেশনামা। বাঙালির মনের জোর গেল বেড়ে। বাঙালি বুঝে গেল কী করতে হবে সামনের দিনগুলোতে। পাকিস্তানিরাও হতভম্ব হয়ে পড়ল। বঙ্গবন্ধুর চাতুর্যময় রাজনৈতিক চালের বিপরীতে তারা চালল নগ্ন একটি চাল। নিরীহ এবং নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হল। শুরু হল প্রত্যক্ষ মুক্তিসংগ্রাম। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও বীরঙ্গণাদের কথা শুনে হাসে তারা সবচেয়ে বড় হারামজাদা।
সিটি মেয়র বলেন, ৭ মার্চ বাঙালি জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল এক দক্ষ কৌশলীর সুনিপুণ বক্তব্য। বঙ্গবন্ধুর ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি জনগণ ও শাসকশ্রেণির নাড়ি বুঝতেন। জনগণের সাথে তার যোগাযোগের ক্ষমতা ছিল অনবদ্য। সহজ-সাবলীলভাবে তার কথাগুলো জনগণকে বুঝিয়ে দিতে পারতেন।
এদিকে গতকাল মেলার ১৬তম দিনও ছিল জমজমাট। মেলায় আসা পাঠকের ভিড় ছিল। সবার হাতেই ছিল নতুন কেনা বইয়ের প্যাকেট। গতকাল পাঠকের আগ্রহে থাকা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আকতার হোসাইনের ‘আহানের জন্য ছড়া’, আ.ফ.ম মোদাচ্ছের আলীর ‘ভাইয়েরা আমার’, রাসু বড়ুয়ার ‘স্প্নভরা ছন্দছড়া, মীর নাজমিনের ‘আলোর রাজা রুবাব’, কাঞ্চন মহাজনের ‘চট্টগ্রামের সড়কের নামকরণের ইতিহাস’, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘জাতীয়তাবোধের উদ্বিগ্ন হৃদয়’।
শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার অসাধারণ এক পটভূমি মীর নাজমিনের ‘আলোর রাজা রুবাব’। রাসু বড়ুয়া তার শিশুতোষগ্রন্থ ‘স্প্নভরা ছন্দছড়া’ সম্পর্কে বলেন, এটি আমার প্রথম গ্রন্থ। ২৬টি মিষ্টি মধুর ছন্দময় শিশুতোষ ছড়া রয়েছে বইয়ে। তবে তা ছোট-বড় সকলকে তুষ্ট করবে বলে আশাবাদী। কাঞ্চন মহাজনের ‘চট্টগ্রামের সড়কের নামকরণের ইতিহাস’ এর ভূমিকায় লেখা হয়, সড়কের নামকরণের ইতিবৃত্ত হলেও এতে পরিস্ফুট হয়েছে সর্বধর্মী সমন্বয়ী সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালচিত্রও।