বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের ১৪ বছর বা প্রায় ৪ হাজার ৬৭৫ দিন কারাগারে ছিলেন। প্রকৃতির প্রতি যেমন তাঁর প্রেম ছিল ঠিক তেমনি বইপ্রেমীও ছিলেন। ছিলেন একজন ভালো পাঠকও। বই পড়তে পছন্দ করতেন। তাঁর পছন্দ তালিকায় ছিল, রবীন্দ্র, শরৎচন্দ্র, নজরুল রচনাবলী, র্জজ বার্নার্ড ’শ, আলবেরুনির ভারততত্ত্ব, মির্জা গালিব, শেকসপিয়র, মাওসেতুং–র বই। ১৯৫০ সালে ২১ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেল থেকে বঙ্গবন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে চিঠি লিখেছিলেন সেই চিঠিতে আছে ‘গত অক্টোবর কেন্দ্রীয় জেলখানার গেটে যখন আমাদের দেখা হয়েছিল, আপনি কথা দিয়েছিলেন, আমাকে কিছু বই পাঠিয়ে দেবেন। তবে এখনও কোনো বই পাইনি। ভুলে যাবেন না এখানে আমি একা আর বই আমার একমাত্র সঙ্গী।’ আহা বঙ্গবন্ধুর বইয়ের প্রতি কত প্রেম ভালোবাসা এ থেকে বুঝা যায় তিনি সত্যিকারের একজন ভালো পাঠকও ছিলেন। শুধু তাই নয় ১৪ বছর তিনি কারাগারে বসে তিনটি বই রচনা করেছেন। প্রথম বই ছিল ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’(২০১২) , দ্বিতীয় বই ‘কারাগারের রোজনামচা’(২০১৭), তৃতীয় বই ছিল ‘আমার দেখা নয়া চীন’(২০২০)। ১৯৬৬ সালের ৮ মে যখন তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। একদিন জেলগেটে বঙ্গবন্ধুর জীবনসঙ্গিনী বেগম ফজিলাতুন্নেছা তাঁকে দেখতে আসেন এবং বলেন ‘বসে তো আছো লেখ তোমার জীবন কাহিনী’। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘লিখতে যে পারি না। আর এমন কী করেছি, যা লেখা যায়। আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকুই বলতে পারি নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ বই লেখার জন্য তাঁর সহধর্মিণী বেশি অণুপ্রাণিত করেছিলেন। বই লেখার জন্য তাঁকে খাতা কলমও কিনে দিয়েছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা, শৈশব, কৈশোর এবং দুরন্তপনা, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, কলকতার দাঙ্গা, দেশভাগসহ ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোর কথা উঠে এসেছে।
‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি সত্যিই অসাধারণ। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহেনা বইটির নামকরণ করেন। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ এবং তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ ৬ দফার গুরুত্বসহ তাঁর পরিকল্পনা, নিজস্ব ভাবনাসহ জেলখানার কাহিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন, পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপ্রেমী। কাকের উৎপাত বঙ্গবন্ধুর ভালো লাগত না। বিরক্ত হতেন। একদিন বাগানি কাদের মিয়াকে কাকের বাসা ভেঙে দিতে বলেন। বাসা ভাঙার পরও কাক জড়ো হয়ে চিৎকার করত। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘কিছু সঙ্গী জোগাড় করে ওরা কাদেরকে গাছে আক্রমণ করত। দুই–একদিন শত শত কাক যোগাড় করে প্রতিবাদ করত। ওদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদকে আমি মনে মনে প্রশংসা করলাম। বাঙালিদের চেয়ে ওদের একতা বেশি।’ কিছুদিন পর কাকরা বঙ্গবন্ধুকে দেখলে বেশ বিরক্ত করত, কাক ভাবত বঙ্গবন্ধু তাদের ঘর ভাঙবে। পরবর্তীতে কাক বঙ্গবন্ধুকে বিরক্ত করত না প্রতিবাদও করত না আর নিন্দা প্রস্তাবও পাশ করে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তৃতীয় বই ছিল ‘আমার দেখা নয়া চীন’ এই বইটি প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে । এটিও জেলে থাকার সময় রচনা করেছেন। চারটিখানি কথা না, বঙ্গবন্ধুর কত ধৈর্য কত কত সহিষ্ণু কত শান্ত থাকলে তিন তিনটি বই রচনা করেন। ১৯৫২ সালের চীনের পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়া ও প্রশান্তমহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। সে সময় নয়াচীন দেখার বেশ অভিজ্ঞতার কথাও বইটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন। চীন ভ্রমণ কাহিনিও তুলে ধরেন এবং চীনের মানুষেও সংস্কৃতি, সমাজ, দর্শনও এসেছে বইটিতে।