ফ্রিকোনমিক্স শব্দটি সাধারণের কাছে বহুল প্রচলিত না হলেও অর্থনীতিবিদদের কাছে অতি পরিচিত। কেননা শব্দটি আচরণগত অর্থনীতি (বিহেভিয়ারাল ইকোনমিক্স) এর সাথে অন্তরঙ্গভাবে সম্পর্কিত।
২০০৫ সালের ১২ এপ্রিল শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ স্টিভেন লেভিট এবং নিউইয়র্ক টাইমস এর সাংবাদিক স্টিফেন জে ডাবনার–তাঁদের প্রথম প্রকাশনা ফ্রিকোনমিক্স বইয়ের মাধ্যমে অর্থনীতির বিভিন্ন তত্ত্ব কীভাবে সামাজিক সমস্যার মাঝে ব্যবহৃত হতে পারে তার বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন।
ইকোনমিক্স বনাম ফ্রিকোনমিক্স
ইকোনমিক্স বা অর্থনীতি এমনই একটি বিষয় যা মানুষের আচরণগত দিকগুলো বিশ্লেষণ করে এবং তা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে সর্বাত্মক কার্যসম্পাদন করে।
ফ্রিকোনমিক্স হলো অর্থনীতির একটি নির্দিষ্ট জনপ্রিয় পদ্ধতি যা জীবনের আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন দিকগুলি বিশ্লেষণ করার জন্য অর্থনৈতিক নীতিগুলো ব্যবহার করে। ফ্রিকোনমিক্স হলো উৎসাহ, তথ্য, এবং সকল বিষয়ের লুকানো দিক। ফ্রিকোনমিক্স অপরাধ থেকে শুরু করে অভিভাবকত্ব —বিভিন্ন বিষয় অন্বেষণ করে দেখায় যে জিনিসগুলি প্রায়শই যা মনে হয় তা হয় না। আমরা আমাদের নৈতিকতা এবং আদর্শের মাধ্যমে জিনিসগুলি দেখার প্রবণতা রাখি, যখন সবকিছু আসলে অর্থনৈতিক উৎসাহ এবং নিরুৎসাহিতার উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়।
ফ্রিকোনোমিক্স হল ‘অদ্ভুত’ গবেষণা এবং অন্তর্দৃষ্টি মূলত আচরণকে উদ্দীপক এবং অপ্রীতিকর (পুরস্কার এবং শাস্তি) আচরণকে ব্যাখ্যা করার বিষয়। কখনও কখনও প্রণোদনা স্পষ্ট হবে, কিন্তু প্রায়শই সেগুলি লুকানো থাকবে – এবং সেগুলি উন্মোচন এবং মানচিত্র তৈরি করার জন্য গবেষণামূলক অনুসন্ধানের প্রয়োজন হবে।
ফ্রিকোনোমিক্সের ধারণা
অর্থনীতি মূলত, প্রণোদনার অধ্যয়ন: কীভাবে লোকেরা প্রণোদনা যা চায় বা যা প্রয়োজন তা পায়, বিশেষ করে যখন অন্য লোকেরাও একই জিনিস চায় বা প্রয়োজন হয়।
তথ্য হলো একটি আলোকবর্তিকা, একটি আলিঙ্গন, একটি জলপাই শাখা, একটি প্রতিবন্ধক –সবকিছুই নির্ভর করে কে এবং কীভাবে এটি ব্যবহার করে তার উপর।
তথ্যের চেয়ে শক্তিশালী আর কিছুই নেই, বিশেষ করে যখন এর ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়।
যদি নৈতিকতা একটি আদর্শ বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে, তাহলে অর্থনীতি প্রকৃত বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে।
ফ্রিকোনমিক্সের এর ব্যাখ্যা অনুসারে অর্থনীতি হলো মূলত প্রণোদনা, মানুষের পছন্দের পিছনের প্রেরণা। এই প্রণোদনার দুটো দিক রয়েছেঃ ইতিবাচক এবং নেতিবাচক। ব্যক্তি বিশেষে প্রণোদনা বাস্তবায়িত হয় কল্যাণকর বা অকল্যাণকর রূপে।
প্রণোদনা বা ইনসেনটিভ কী?
প্রণোদনা শব্দের অর্থ হচ্ছে, কর্মপ্রেরণা, মানে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করা। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রণোদনা হল বস্তুগত পুরস্কার এবং জরিমানা যা নির্দিষ্টভাবে আচরণ করার জন্য প্রাপ্ত বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। প্রণোদনা তিনটি স্বাদে আসে:
অর্থনৈতিক প্রণোদনা – বস্তুগত লাভ/ক্ষতি (আমাদের জন্য যা সবচেয়ে ভালো তা করা)
সামাজিক প্রণোদনা – খ্যাতি লাভ/ক্ষতি (সঠিক কাজ করার জন্য দেখা)
নৈতিক প্রণোদনা – বিবেকের লাভ/ক্ষতি (‘সঠিক‘ কাজটি করা/না করা)
কেন প্রণোদনা গুরুত্বপূর্ণ?
মানব জীবনে প্রণোদনার গুরুত্ব অপরিসীম। কর্মক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর এর অবদান রয়েছেঃ
১। কর্মচারীর কর্ম স্পৃহা বৃদ্ধিতে– যখন কর্মীরা প্রণোদনা রূপে পুরস্কার দ্বারা অনুপ্রাণিত হন, তখন তাদের কাজের স্পৃহা বাড়ে, কাজের গতি বাড়ে।
২। বর্ধিত উৎপাদনশীলতা– প্রণোদনা কর্মীদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য আরও বুদ্ধিমান এবং কঠোর পরিশ্রম করতে চালিত করতে পারে।
৩। প্রতিভা আকর্ষণ এবং ধরে রাখা– একটি শক্তিশালী প্রণোদনা কর্মসূচি ব্যবসাগুলিকে শীর্ষ প্রতিভা আকর্ষণ করতে এবং টার্ন ওভার করতে সহায়তা করে।
৪। উন্নত কর্মসন্তুষ্টি– স্বীকৃতি এবং পুরস্কার কর্মীদের প্রশংসা বোধ করায়, কাজের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করে।
প্রণোদনা যখন প্রতারণা: প্রণোদনা তখনই প্রতারণা হিসেবে বিবেচিত হবে যখন এটিকে প্রতারণামূলক বা অসাধু উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, যার মাধ্যমে কোনও ব্যক্তিকে মিথ্যে তথ্য প্রদান করে বা প্রতারণার মাধ্যমে তার সম্পত্তি, অর্থ বা অন্য কোন সুবিধা আত্মসাৎ করা হয়। ‘প্রণোদনা যখন প্রতারণা‘ বলতে বোঝায় এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে একটি আপাতদৃষ্টিতে ভালো বা সহায়ক প্রস্তাব আসলে একটি প্রতারণামূলক ফাঁদ, যা কাউকে শোষণ বা ক্ষতি করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
মূলত তথ্য (অথবা এর অভাব) আচরণ এবং সিদ্ধান্তগুলিকে দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এর প্রভাব নির্ভর করে কার কাছে এটি আছে এবং কীভাবে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপর। তথ্যের অসামঞ্জস্যতা তখন ঘটে যখন লেনদেনের এক পক্ষের কাছে অন্য পক্ষের চেয়ে ভালো তথ্য থাকে।
ফ্রিকোনোমিক্স বইয়ে লেখকরা তথ্যের শক্তি দেখান – কীভাবে এটি একটি গোপন সমাজকে ধ্বংস করে দেয়, কীভাবে অনুমান করা তথ্য মানুষের আচরণকে রূপ দেয় এবং কীভাবে বিশেষজ্ঞরা (যেমন ডাক্তার, আইনজীবী, রিয়েল–এস্টেট এজেন্ট) তাদের সুবিধার জন্য তথ্যগত সুবিধা ব্যবহার করে। এমনকি শিক্ষক, গবেষকগণ ও নানা উপায়ে তথ্যের অপব্যবহার করে।
এছাড়া ‘প্রচলিত জ্ঞান’ হল এমন ধারণা যা মানুষের স্বার্থ, আত্মসম্মান এবং সুস্থতাকে শক্তিশালী করে। তাই দুর্ভাগ্যবশত, বেশিরভাগ প্রচলিত জ্ঞান সুবিধাজনক এবং সান্ত্বনাদায়ক, এবং সংবাদমাধ্যম (বিজ্ঞাপন সহ) ও ভুল ‘তথ্য’ তে অবদান রাখে। আমাদের জটিল বিশ্বকে বুঝতে এবং সরলীকরণ করতে, আপনাকে কী পরিমাপ করতে হবে এবং কীভাবে তা করতে হবে তা জানতে হবে।
ছোটবেলায় শামসুর রাহমান এর একটি কবিতা ‘পন্ডশ্রম’ পড়েছিলাম যেখানে কবি লিখেছেন ‘চিলে কান নিয়ে গেছে’ কথাটি কেউ ছড়িয়ে দিল আর আমরা ও চিলের পিছে, কানের খোঁজে ঘুরে মরি। তথ্যের সত্যতা যাচাই না করে আমরা অহেতুক ছুটে চলি। বর্তমানে ভাইরাল জ্বরে আমরা সবাই আক্রান্ত। সত্য শোনার বা যাচাই করার সময় নেই কারো, ইচ্ছে হলো নিছক মনগড়া কিছু তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করে দেয়া যায়। একটু ভাবলেই বুঝতে পারি, সামাজিক মাধ্যমের ভিড়ে আমরা দিনদিন কতোটা অসামাজিক হয়ে পড়ছি। কাউকে সম্মান করাতো দূরে, কীভাবে কারো নিন্দা, বা তার দুর্নাম করা যায় আমরা তাতেই ব্যস্ত।
আমরা যারা গবেষণা করি তারা একটি রিসার্চ পেপার লেখার পর তা পিয়ার রিভিউ তে মূল্যায়নের জন্য পাঠানো হয়। তার অর্থ আমার সমমানের কেউ আমার মূল্যায়ন করার অধিকার রাখে। কিন্তু গবেষণা ছাড়া অন্য সবকিছুতে মানুষ অন্যের সমালোচনা নিয়ে এতো মরিয়া হয় যার কোনও যোগ্যতাই নেই তার সমকক্ষ হওয়ার। তাই আমাদের আচরণ এর পরিবর্তন সবার আগে দরকার, তবেই আমাদের উন্নয়ন, দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন। ফ্রিকোনোমিক্স অন্তর্দৃষ্টি অনুসন্ধান এবং উন্মোচনের জন্য একটি ব্যবহারিক পদ্ধতি প্রদান করে। যেখানে স্বাভাবিকতা, প্রাপ্ত জ্ঞান বা প্রত্যাশা ব্যাহত হয় সেখানে অন্তর্দৃষ্টি অনুসন্ধান এবং তারপরে আচরণের জন্য প্রণোদনা কাঠামোর মানচিত্র তৈরি করতে হয়। এর মধ্যে কেবল অন্তর্দৃষ্টিই নয়, আচরণ পরিবর্তনের সুযোগও রয়েছে।
দৃশ্যত যা ঘটে বা পরিদর্শন হয় তার সত্যতা কতটুকু তা বিচারের সঠিক জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয় কেননা সবকিছুরই কিছু লুকায়িত দিক থাকে, যা অনেক সময় আমাদের নজরে পড়ে বা অনেক সময় আমরা বিচার্য মনে করি না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিশেষ করে শিশুদের শিক্ষা নিয়মিত করণের জন্য, বাল্য বিবাহ রোধের জন্য অভিভাবকদের প্রণোদনা প্রয়োজন, এছাড়া নারীদের কর্মে পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে, তাদের সামাজিক নিরাপত্তাদানে প্রণোদনা, প্রবাসী আয়ে বা রেমিট্যান্সে প্রণোদনা প্রয়োজন। সর্বোপরি বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরের দুর্নীতি দমনেও প্রণোদনা প্রয়োজন। বিপত্তি তখনই হয় যখন প্রণোদনা প্রতারণায় রূপ নেয় কেননা আমরা আমাদের আচরণগত নীতি থেকে স্খলিত হয়ে পড়ি। তার জন্য দরকার আমাদের নৈতিক শিক্ষা, দরকার হলুদ সাংবাদিকতা এবং তথ্য বিভ্রাটকারীদের উপযুক্ত শাস্তি। আচরণ সঠিক তো অর্থনীতি ও সমৃদ্ধ। তাই নীতিতে আমরা নত হবো, দুর্নীতিতে নয়।
লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ, প্রভাষক, অর্থনীতি, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।