ফ্রান্সে নাহেলের মৃত্যু ধর্মবিদ্বেষী চেহারাকেই মনে করিয়ে দেয়

ড. ফরিদুল আলম | রবিবার , ৯ জুলাই, ২০২৩ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

ফ্রান্স এখন বিক্ষোভে উত্তাল। ১৭ বছর বয়সী আলজেরীয় বংশোদ্ভূত নাহেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষের মিছিলে সরব দেশটি। ফ্রান্সে অবশ্য এটিই প্রথম নয়। এর আগেও বার কয়েক এধরনের প্রতিবাদী সমাবেশ ঘটেছে। সর্বশেষ ২০০৫ সালে রোজার মাসে ১১ জন যুবক একটি মাঠে ফুটবল খেলা শেষ করে ইফতারের আগে রওনা দিয়ে নির্মিয়মাণ একটি ভবনে ঢুকে পড়লে স্থানীয় এক বাসিন্দা কর্তৃক সন্দেহের কারণে পুলিশকে খবর দেয়া হলে পুলিশ এসে তাদের মধ্যে একজনকে ধরে নিয়ে যায়। বাকী কয়েকজন একটি বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনে পালিয়ে থাকে। এতে এদের মধ্যে দুইজন বিদ্যুতপৃষ্ট হয়ে মারা যায় এবং একজন গুরুতর আহত হয়। সেসময়ের ঘটনা মনে করে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে অনেক চিৎকারের পর কোন মানুষ তাদের উদ্ধার বা সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। সে ঘটনায় মানুষ বিক্ষোভে ফুঁসে উঠলে দেশটির একজন মন্ত্রী এই বালকদের চোর বলে অভিহিত করে। সে ঘটনার রেশ এতটাই ছড়িয়ে পরেছিল যে সরকারকে শেষ পর্যন্ত জরুরী অবস্থা জারী করতে হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে সে ক্ষোভ প্যারিস থেকে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য শহরেও। প্রায় ৩ সপ্তাহ ধরে চলা এই সহিংসতায় হাজার হাজার ঘরবাড়ী, গাড়ী এবং বিদ্যুৎ স্টেশন পুড়িয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা।

এবারের ঘটনাটি নাহেলকে নিয়ে। পুলিশের তরফে দাবী করা হয়েছে সে ট্রাফিক আইন অমান্য করেছে, সংকেত দেয়া সত্ত্বেও থামেনি, তার বয়স ১৭ বছর, অর্থাৎ তাঁর গাড়ী চালাবার লাইসেন্স নেই এবং সর্বোপরি সে মাদকাসক্ত। পুলিশের এই দাবীর বিপরীতে যে কারণে সাধারণের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে তা হল তাঁর যত দোষই থাকুকনা কেন, পুলিশ নির্বিচারে মানুষ হত্যার অধিকার রাখেনা। নাহেলের মা অভিযোগ করে বলেছেন, নাহেলের চেহারায় পুলিশ আরবের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছে বলে তাকে হত্যা করা হয়েছে। একই সাথে তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এবং অপরাপর আত্মীয়স্বজন এটাও দাবী করেছেন যে তারা কোনভাবেই কোন সহিংস কর্মসূচীর পক্ষ্যে নন, এতে বরং নাহেলের স্মৃতির প্রতি অসম্মান করা হয়। কিন্তু যা ঘটে চলছে তা থেকে যা বুঝা যায় ক্ষোভ এবং ক্রোধ স্বতঃস্ফুর্তভাবে মানুষের মাঝে কাজ করছে। সাধারণ মানুষ ট্রাফিক পুলিশ চৌকিতে ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। জানা যায় এধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের ফলে এবছরের প্রথম ৬ মাসে নাহেলসহ পুলিশের গুলিতে ৩ জন প্রাণ হারায়। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১৩। ২০১৭ সালে ফ্রান্সের প্যানাল কোড পরিবর্তন করে পুলিশকে তল্লাসী চৌকিতে ভারী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। এর কারণ হিসেবে সসময় জানানো হয় যে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা প্রায়শই নানাভাবে আক্রান্ত হয়ে উঠছিল। পুলিশকে এধরণের অস্ত্র রাখার অনুমতি দেয়ার অর্থ এটা নয় যে তারা এর যথেচ্ছা প্রয়োগ করবে, বরং এর মূল কারণ তাদের আত্মরক্ষা। এখানে যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত সত্য তা হচ্ছে নাহেল পুলিশের নিরাপত্তার জন্য কোনভাবের হুমকী ছিলনা। তাহলে কেন তাঁর বুক বরাবর বন্দুক ঠেকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হল তাকে? তবে কি এটাই সত্য, যা নাহেলের মা বলেছেন, অর্থাৎ আরব বলে এধরনের পরিণতি বরণ করতে হয়েছে তাকে?

এর উত্তরে আমরা বলতে পারি যে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশীসংখ্যক অর্থাৎ ৬০ লক্ষ মুসলিমের বাস ফ্রান্সে, যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। আইনগতভাবে দেশটি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে আসলেও মুসলমানদের প্রতি তাদের বিদ্বেশ পুরানো কিছু নয়। ২০০৪ সালে ফ্রান্স সরকার আইন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের হিজাব পরিধান নিষিদ্ধ করে। ফলে কট্টর ধর্মানুরাগী অনেক শিক্ষার্থীর পরাশুনা বন্ধ হয়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে দাবী করে বলা হয় যে মুসলমান মেয়েদের হিজাব পরিধান করা তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির লঙ্ঘন। তবে বাস্তবে যা দেখা যায় তা হল তাদের সামাজিকভাবে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের কটূক্তির সম্মুখীন হতে হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৮০র দশক থেকেই ফ্রান্সে মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধানকে একটি ইস্যু করা হতে থাকে এবং ১৯৯০ এর দশক থেকে দেশটিতে ব্যাপকভাবে মুসলিম নারীদের হিজাব পড়া উচিৎ কি না সেটা নিয়ে নানা বিতর্ক দানা বেধে উঠতে থাকে। এর মধ্য দিয়ে মুসলিমদের প্রতি দেশটির সাধারণ জনগণের মনে বিদ্বেষও বাড়তে থাকে। এতে ফ্রান্সের ধর্ম নিরপেক্ষনীতি গভীরভাবে সংকটে পতিত হয়।

ফ্রান্সের মুসলিমবিদ্বেষী এই মনোভাব যে কেবল দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রীষ্টানদের সেটা বলার অবকাশ নেই, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে সরকারের তরফ থেকে আইন সহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে মুসলিম বিদ্বেষ স্পষ্ট। বিভিন্ন মন্ত্রী ও রাজনীতিকরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গিয়ে মানুষকে বলতে শুরু করেন যে ইসলাম গোটা দেশের জন্য একটা ঝুঁকি হয়ে উঠছে। মুসলিম নারীরা শিশুদের সমতুল্য। নিজেদের ব্যাপারে তারা নিজেরা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাদের জীবনের যে কোন সিদ্ধান্তের পেছনে থাকেন তাদের বাবা নয়ত ভাই। আর মুসলিম পুরুষ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয় যে তারা বহুগামী ও সহিংস। এটাই ছিল মুসলিমদের প্রতি মানুষের মনে একটা ভীতি তৈরির পথ। এক কথায় মুসলমানরা এবং ইসলাম ধর্ম দেশটির জন্য যে বিপজ্জনক মানুষের মনে সেই ধারণাটা গেঁথে দেয়া।

এর আগে ২০২০ সালে প্যারিসের কাছে অভিবাসী অধ্যুসিত এক জনসভায় ঘন্টাব্যাপী বক্তব্যে মুসলিমদের উপর নিজের ক্ষোভ ঝেরেছেন স্বয়ং দেশটির প্রেসিডেন্ট এমান্যুয়াল ম্যাখো। তিনি ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষনীতিকে নীতিকে হুমিকীতে ফেলার জন্য স্পষ্টভাবে দোষ দিয়েছেন মুসলিম সমপ্রদায়কে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন যেসব ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষনীতিকে হুমিকীতে ফেলবে তাদের বিরুদ্ধে নতুন আইন করবেন তিনি। ফরাসী সমাজের এই কথিত শত্রু হিসেবে তিনি সরাসরি মুসলমানদের অভিযুক্ত করেন।

তিনি যদিও তাঁর ভাষণে জানান তিনি ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমানদের বিপক্ষ্যে নন, তবে এটিও জানিয়ে দেন যে পুরো বিশ্বে ইসলাম এক সংকটে নিমজ্জিত, এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও এই ধর্মটি এখন সংকটে রয়েছে। তিনি ইসলামের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘এমন একটি ইসলামের প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার অর্থ হবে জ্ঞানের আলো।’ অবশ্য ফ্রান্সে ইসলাম নিয়ে এধরনের কথা এই প্রথম কোন প্রেসিডেন্ট বলেননি। এর আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলো সারকোজিও ইসলামের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।

আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল ফ্রান্সে পুলিশের গুলিতে যুবক নেহাল হত্যাকে কেন্দ্র করে। এখানে ইসলাম কিভাবে দেশটির পুলিশের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হল তা পরিষ্কার হবে নাহেলের মায়ের আরেকটি বক্তব্য থেকে। তাঁর দাবী তারা নাহেলকে চিনতো, অর্থাৎ নাহেল যে একজন মুসলিম তা আগে থেকেই জানা ছিল পুলিশের। পুলিশের এই আচরণ এক্ষেত্রে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি দেশব্যাপী মুসলিম বিদ্বেষের একটি খন্ডিত চিত্র। আমরা জানি ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স এবং জার্মানীর মানবাধিকার পরিস্থিতি সবচেয়ে উন্নত।এর বাইরেও ইউরোপে মানবাধিকার বিষয়ক একটি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন কার্যকর রয়েছে। সারা পৃথিবীর মানবাধিকার নিয়ে তারা সবসময় সরব রয়েছে। এখানে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে ধর্মনিরপেক্ষতার নাম নিয়ে তারা যেভাবে কেবল ইসলাম এবং মুসলিমদের লক্ষবস্তুতে পরিণত করার চেষ্টা করছে এতে যে মানবাধিকারের চরম ব্যত্যয় ঘটছে তা কিন্তু ইউরোপব্যাপী এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে উপেক্ষিত রয়ে গেছে। উপরন্তু ইসলামের সংস্কারের কথা বলে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের হুমকী দিয়ে তারা কার্যত ইসলাম ধর্মকে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা করে যাচ্ছে। তাদের তরফ থেকে দাবী করা হয়েছে যে গেল প্রায় একদশক সময়ের মধ্যে দেশটিতে একাধিক জঙ্গী হামলায় কয়েকশ লোক নিহত হয়েছে। কিন্তু একটিবারের জন্যও যে বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি সেটি হচ্ছে ইসলাম এবং জঙ্গিবাদ এককথা নয়। যারা জঙ্গী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত তাদের কোন ধর্ম থাকতে পারেনা। তাছাড়া উন্নত দেশগুলোতে যখন অমুসলিমদের দ্বারা জঙ্গী ঘঠনা সঙ্ঘঠিত হয় তখন কিন্তু কোন নির্দিষ্ট ধর্মকে দোষারোপ করা হয়না। মানবাধিকারের নামে একটি ধর্মকে লক্ষবস্তু করে ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওরানো পশ্চিমা সভ্যতা কতটুকু সভ্য সেটা নিয়ে প্রশ্ন করাই যেতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে