সদ্যপ্রয়াত শিক্ষাবিদ ইফতেখার আহমেদ খানের স্মৃতিতে উৎসর্র্গীত
একটা কথা বলা হয়ে থাকে, A থেকে Z পর্যন্ত প্রতিটি অক্ষরে একজন করে ফরাসি চলচ্চিত্রকারের নাম পাওয়া যায়। কথাটি মজা করে বলা হলেও এটি বাস্তব। ফরাসি দেশটিতে সিনেমার কদর তার জন্মলগ্ন থেকে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়–উভয় ক্ষেত্রেই এই শিল্প মাধ্যমের প্রতি ফরাসিদের গভীর অনুরাগ ও প্রণোদনা। ১৮৮৯ সালের ৬ অক্টোবর নিউইয়র্কের সান্তা মারিয়া স্টুডিওতে টমাস আলভা এডিসন ও উইলিয়াম কেনেভি ডিকসনের যৌথ গবেষণায় সিনেমা আবিষ্কৃত হলেও জনসমক্ষে সিনেমা প্রথম প্রদর্শিত হয় ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় প্যারিসের গ্র্যান্ড ক্যাফেতে লুই ও আগস্ট লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের উদ্যোগে। সেই শুভ সূচনা থেকে অদ্যাবধি ফ্রান্সের চলচ্চিত্রশিল্প চলমান রয়েছে সৃষ্টিশীল গতিশীলতায়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের প্রথম সে দিনটাকেই ইউনেস্কো বিশ্বচলচ্চিত্রের জন্মদিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ফরাসি চলচ্চিত্র উদ্ভাবনী শক্তি ও কলানৈপুণ্যের বিরল এক সমন্বয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় যখন চলচ্চিত্রের প্রকরণগুলির পরিবর্তন ও পরিমার্জনার কাজ কেবলমাত্র শুরু হয়, সে সময়েই ফরাসি চলচ্চিত্রের বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে রীতিমতো পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিল। অর্থাৎ ফ্রান্সে শুরু থেকেই চলচ্চিত্রশিল্প বেশ ভালোভাবেই স্থিতি অর্জন করে নিতে পেরেছিল। নিঃসন্দেহে এ কাজ ছিল খুব চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু এই সাহসিকতাই চলচ্চিত্রবিশ্বে ফ্রান্সের সিনেমাকে শুরু থেকেই সম্ভ্রম ও আভিজাত্যের আসনে অধিষ্ঠিত করে রেখেছে।
আরও অনেক ক্ষেত্রেই ফ্রান্স বিশ্বচলচ্চিত্রের পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল ফ্রান্সে ১৮৯৫ সালে লুমিয়ের ভাইদের পরিচালনায়। প্রথম প্রেক্ষাগৃহ নির্মিত হয় এদেশে। চলচ্চিত্রকে রঙিন করে তোলার প্রথম উদ্যোগটি নেন ফ্যান্সের জর্জ মেলিয়ে, ট্রিক শট আবিষ্কারের কারণে যাঁকে চলচ্চিত্রের জাদুকর বলে অভিহিত করা হয়। প্রথম চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানটিও ছিল ফ্রান্সের প্যাথে কোম্পানি, যেটি চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও সাজ সরঞ্জাম উৎপাদন এবং রপ্তানি করতো সারা বিশ্বে। প্রথম চলচ্চিত্র মেলা অনুষ্ঠিত (প্রথম উৎসব ইতালির ভেনিসে) হয় প্যারিসের ১৯০০ সালে। নাম ছিল Expo- 1900। ১২টি ছোট ছবি প্রদর্শিত হয় সে মেলায়। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে নির্মিত ছবির ৮৫ শতাংশ তৈরি হতো ফ্রান্সে। এরকম উদাহরণ আরও রয়েছে। ফরাসি চলচ্চিত্রের সমৃদ্ধ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অর্জিত বিচিত্র জীবনীশক্তি তাকে যুগ যুগ ধরে বিশ্বের পুরোধা করে রেখেছে।
ফ্রান্স বিশ্বচলচ্চিত্রকে উপহার দিয়েছে অনেক। ফ্রান্সের ন্যুভেল ভাগ বা নবতরঙ্গ চলচ্চিত্র আন্দোলন, অথরশিপ তত্ত্ব–সারা দুনিয়ার সিনেমার সনাতনী ধ্যান ধারণায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। ফ্রান্স উপহার দিয়েছে ‘কাইয়ে দ্যু সিনেমা’র মতো কালজয়ী চলচ্চিত্র পত্রিকা যা চলচ্চিত্র সমালোচনার প্রচলিত ধারাকে ভেঙেচুরে গড়ে দেয় নতুন এক রীতি যার মধ্য দিয়ে একটি চলচ্চিত্র না দেখেও তার আস্বাদ পাওয়া যায়। আর এসব আন্দোলন, তত্ত্ব ও পত্রিকার সূত্র ধরেই একে একে উঠে এসেছিলেন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, জঁ লুক গোদার, ক্লদ শ্যাব্রল, জ্যাক রিভেত, এরিখ রোহমের, অঁরি ক্লুজো, অ্যালাঁ রেনে, জর্জ ফ্রানজু, আগনেস ভার্দা, লুই মাল, রোবের ব্রেসোঁ, জ্যাক দেমি, ক্রিস মার্কার–এঁদের মতো যুগশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার যাঁরা এসেছিলেন জঁ ককতো, লুই বুনুয়েল, জঁ রেনোয়া, আবেল গাঁস, জঁ গ্রেমিয়ে, মার্সেল কার্নে, জঁ ভিগো, রেনে ক্লেয়ার প্রমুখ চলচ্চিত্রগুরুর হেঁটে চলার সোনালী পথরেখা ধরে। ন্যুভেল ভাগ আন্দোলন উপহার দিয়েছে আঁদ্রে বাজাঁ, জর্জ শাদুলের মতো দিগ্বিজয়ী চলচ্চিত্র সমালোচক, রাউল কুতার ও অঁরি ডিকের মতো ভুবন মাতানো সিনেমাটোগ্রাফার এবং জঁ পল বেলমেন্দো, জেরার দৈপারদিউ, ইসাবেলা হিউপার্ট, ইমানুয়েল রিভা, জান মরো, ইসাবেলা আদজানি, মারিয়াম রাসুল, আনুক এমি, আনা কারিনা, আনা ভিয়াজেমস্কি, মিশেল পিকোলি, জঁ লুই ত্রিঁতিগনাঁ, জান সেবার্গ, অ্যালাঁ দেলোঁ, রোমি শ্লাইডার, ক্যাথরিন দানিউবের মতো কালজয়ী অভিনয়শিল্পী যাঁরা অভিনয়ে এসেছিলেন জঁ গাভাঁ, সিমোন সিনোরে, ইভ মঁ তঁ, আভা গার্ডনার, ব্রিজিত বার্দোত, শার্লি ম্যাকলেইন, জেরার ফিলিপ, মিশেল সিমোঁর মতো কিংবদন্তী অভিনয়শিল্পীর পথ ধরে।
এঁদের সকলের গৌরবময় অবদানে ফরাসি চলচ্চিত্র অভিনব ধ্রুপদিয়ানায় পরিপূর্ণতা অর্জন করে। ফরাসি ধ্রুপদী চলচ্চিত্র সারা বিশ্বের কাছে যেমন অনুকরণীয় হয়ে ওঠে, তেমনই ফ্রান্সের মূলধারার চলচ্চিত্রও সুষম মণ্ডিত শৈল্পিতার গুণে সমাদৃত হয়ে ওঠে বিশ্বজুড়ে।
ফরাসি সিনেমার আরেকটি বড় গুণ এর রাজনীতি ও সমাজ সচেতনতা। এছাড়া ফরাসি অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাবও ফরাসি সিনেমায় সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। কিংবদন্তি দুই ফরাসি দার্শনিক জঁ পল সার্ত্র ও আঁদ্রে মালরো এক সময় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়েছিলেন চলচ্চিত্রে। এঁরা চলচ্চিত্র নির্মাণও করেছেন। স্পেনিশ–ফরাসি চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েলের কাজ আবার পরাবাস্তবতার প্রভাব দেখা যায় যা সালভাদর দালিকেও স্মরণে এনে দেয়। জঁ ককতোর চলচ্চিত্রেও আমরা পরাবাস্তবতার প্রভাব দেখতে পাই। এই প্রভাব পাওয়া যায় অ্যাল্যাঁ রেনের অনেক কাজেও।
ফরাসি চলচ্চিত্র বললেই চোখের পাতায় ভেসে আসে চমৎকার সব কম্পোজিশন, বুদ্ধিদীপ্ত আলোকসম্পাত, রঙের ও সাদাকালোর ছন্দোবদ্ধ ও দৃষ্টিনান্দনিক চিত্রায়ণ, শ্রুতিমধুর সুপ্রযুক্ত সংগীত, বিষয়বস্তুর বিবিধ বৈচিত্র্য এবং সর্বোপরি গতিময় ও সন্নিবদ্ধ সম্পাদনা যা একটি ছবিকে টান টান করে গেঁথে রাখে। এসব বিশেষত্বের সমন্বয়ে ফ্রান্সের সিনেমার এমনই একটা ঘরানা তৈরি হয়ে গেছে যে, শৈল্পিক ধারার ছবিগুলো তো অত্যন্ত মানোত্তীর্ণ হয়ে ধ্রুপদী চলচ্চিত্রে পরিণত হয়–এটা বলাই মূলধারার প্রথম শ্রেণির ছবিগুলো তো বটেই, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ছবিগুলোরও একটি সুন্দর মান বজায় থাকে।
ফরাসি সিনেমার এইসব গুণাবলীর নেপথ্যে রয়েছে বিশেষ একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। আভাঁ গার্দ আন্দোলন নামেই তা বিশ্বখ্যাত। এই আন্দোলনের ভিত্তি হলো দাদাইজম ও সুরিয়ালিজম। এই দুই গোষ্ঠীর শিল্পী ও শিল্পকর্মের প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায় আভাঁ গার্দ আন্দোলন গড়ে ওঠে। প্রথম থেকেই চারুকলার সঙ্গে ফ্রান্সের চলচ্চিত্রের একটি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক ছিল সাহিত্যের সঙ্গেও। ছিল দু’টোরই উত্তরাধিকার। যার সূত্র ধরেই এসেছিলেন চিত্রকর অগস্ত রেনোয়ার পুত্র জঁ রেনোয়া, এসেছিলেন চিত্রশিল্পী লুই ফ্যইয়াদ, সালভাদর দালি ও পাবলো পিকাসো, এসেছিলেন কবি জঁ ককতো। ফলে শুরু থেকেই ফরাসি সিনেমা ছিল শিল্পস্নাত, যে ধারাবাহিকতা এখনও বহমান।
ফ্রান্স বিশ্বচলচ্চিত্রে সংযুক্ত করেছে অনেক তত্ত্ব, পরিভাষা, প্রকার–প্রকরণ যা চলচ্চিত্রের ব্যাকরণ গড়ে তুলতে গঠনতান্ত্রিক ভূমিকা রেখেছে। মন্তাজের সৃষ্টি রাশিয়ায় কুলেশভ, পুদভকিন, আইজেনস্টাইনের হাতে হলেও এর পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে ফ্রান্সে। এদেশে চলচ্চিত্র সম্পাদনাকেই মন্তাজ নামে (মঁতাজ) অভিহিত করা হয়ে থাকে। মিজঁ সিন, ফ্ল্যাশ ব্যাক ও ফরোয়ার্ড, ডিপ ফোকাস, শার্প কাট, স্মুথ ম্যাচ কাটসহ আরও অনেক পদ্ধতি ফরাসি দেশের অবদান।
ফ্রান্স পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে ফিল্ম সোসাইটি চর্চা। প্যারিসের লুই দু’লুক ও জারমেইন দু’লুক দম্পতি প্রথমবার ফিল্ম সোসাইটির ধারণা দিয়েছিলেন যা প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডনে। সিনে–কমপ্লেক্স বা সিনেপ্লেক্স বা মাল্টিপ্লেক্সের সূচনাও প্যারিসে। বিশ্বের প্রথম ও বৃহত্তম চলচ্চিত্র কেন্দ্র–সিনেমাথে ফ্রঁসেজ–এর অবস্থানও প্যারিসে। ফিল্ম আর্কাইভের ধারণাটাও গড়ে ওঠে ফ্রান্সে। সে দেশেই অবস্থিত বিশ্বের প্রথম ও বৃহত্তর ফিল্ম আর্কাইভ বা চলচ্চিত্র সংরক্ষণাগার। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফিল্ম আর্কাইভসের সদর দপ্তরও ফ্রান্সে। এদেশের সৈকত শহর কানে ফি বছর বসে বিশ্বের বড় ও সেরা চলচ্চিত্রোৎসব। ফিল্ম সোসাইটিজ ফেডারেশন ও তার আন্তর্জাতিক মোর্চার ধারণাও দেয় ফ্রান্স, যদিও এর সদর দপ্তরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ইতালির রোমে। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের লোগোটিও নির্মাণ করেছেন ফরাসি চিত্রকর পাবলো পিকাসো। ফ্রান্স, কানাডা এবং ইউরোপ, ইন্দোচিন ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ মিলে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ফরাসি ভাষায়।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ফরাসি ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের একটি অধিবেশন। চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ চট্টগ্রামের যৌথ আয়োজনে ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ অধিবেশনে চারটি বিশ্বখ্যাত ধ্রুপদী চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। ছবিগুলি ছিল ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ফোর হানড্রেড ব্লোজ, জর্জ ফ্রানজুর–আইজ উইদাউট এ ফেস, অ্যালাঁ রেনের–হিরোশিমা মনামুর এবং রোবের ব্রেসোঁর–বালাথাজার এট র্যানডম। এ অধিবেশনের প্রচুর দর্শক উপস্থিতি ফরাসি ছবির প্রতি দর্শকের অনুরাগকে আবারও প্রমাণ করেছে।
সামগ্রিকভাবে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক গ্রহণযোগ্যতা ও পৃষ্ঠপোষকতা একেবারে শুরু থেকেই ফরাসি চলচ্চিত্র শিল্পে পরিলক্ষিত হয়। যা তার প্রসারে ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সব মিলিয়ে ফ্রান্সের সিনেমা তার নিজগুণে সিনেমা দুনিয়ায় অর্জন করে নিয়েছে মর্যাদাসম্পন্ন ও সমাদৃত একটি আসন।