প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রতিদিন নিত্যনতুন আবিষ্কার হচ্ছে। বর্তমানে আমরা এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি যেখানে চারিদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়জয়কার। আকাশে পাঠানো থেকে শুরু করে দুর্যোগ মোকাবিলায়, শিক্ষা, বিনোদন, ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার, চিকিৎসা, গবেষণার কাজে, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি চালনা, পানির নিচে উদ্ধার কাজে, রেস্টুরেন্টে খাবার পরিবেশনের ক্ষেত্রে এমনকি ঘরের কাজে ব্যবহার হচ্ছে এই কৃত্রিম মানবটি। তাই আমাদেরও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় সময়োপযোগী প্রযুক্তি বা ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজির ব্যবহার ও উদ্ভাবনের কোনো বিকল্প নেই।
চলুন এবার জেনে আসি ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজিটা কী? সামপ্রতিক সময়ে একেবারে নতুন উদ্ভাবিত উচ্চ অগ্রসর প্রযুক্তিকে বলা হয় ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি বা হাই টেকনোলজি। শব্দটি আমাদের কাছে নতুন মনে হলেও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ১৯৫০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার একটি নিবন্ধে প্রথম ইংরেজি ভাষায় ‘হাই টেকনোলজি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, সেক্ষেত্রে আমদের প্রস্তুতিটা কতটুকু? নাকি বিদেশিদের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করবো খুব গর্ব করে! তবে আশার কথা হলো প্রযুক্তি বিশ্বের সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশেও আর পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তর ও আগামীতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করার লক্ষ্যে এক্ষেত্রে বর্তমান সরকার অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছেন। সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্বল্প, মধ্য, দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। যার মধ্যে চারটি মূল স্তম্ভ হলো স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট বাংলাদেশ মানে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মাধ্যমে সব সেবা দ্রুততম সময়ে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিঙ্কস, ন্যানো টেকনোলজি, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিগ ডাটা অ্যানালাইসিস, ব্লকচেইন, রোবটিক্স, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, থ্রিডি প্রিন্টিং ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। বাস্তবায়িত ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করতে হলে স্মার্ট মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। এজন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হলে আইটি সেক্টরের কোনো বিকল্প নেই। তাই প্রযুক্তিতে আমাদের দেশের তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাদারীপুরের শিবচরে কুতুবপুরে ৭০ একর জায়গা উপর ১৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে ‘শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি ও সফটওয়্যার টেকনোলজি’ পার্ক। দেশের মধ্যে এটিই হবে প্রথম ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলার জন্য দক্ষ প্রজন্ম তৈরি করবে এই ইনস্টিটিউট। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট প্রজন্ম তৈরি হবে এখান থেকে। এই ইনস্টিটিউটে থাকবে ৬ তলা গবেষণা ভবন, ৪তলা একাডেমিক ভবন, শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য ডরমেটরি ভবন ও ৬টি বিশেষায়িত ল্যাব। ল্যাবগুলোতে থাকবে ন্যানো টেকনোলজি থেকে শুরু করে মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই। ল্যাবগুলোতে কাজ করার ফলে গুগল, মাইক্রোসফট কিংবা অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠান এই ইন্সটিটিউট হতে বের হতে পারে ।
এখানে গতানুগতিক শিক্ষার পাশাপাশি পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রযুক্তি জ্ঞানে দক্ষ হয়ে উঠার সুযোগ থাকবে শিক্ষার্থীদের। আমেরিকার ম্যাসাচুসেট্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), ভারতের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি), থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এআইটি) মতো বড় বড় ইন্সটিটিউটগুলোর সাথে এই ইন্সটিটিউটের জয়েন রিসার্চ করার সুযোগ থাকবে। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার তৈরিতে যেমন আমাদের দেশে ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিকেএসপি রয়েছে ঠিক তেমনি এখান থেকেও প্রযুক্তিখাতে তৈরি হবে বিশ্বসেরা প্রযুক্তিবিদ। আশা করা যায় ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে অঙ্গীকার, তা বাস্তবায়নে আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর হাইটেক পার্ক ও শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের মতো প্রযুক্তি অবকাঠামোগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। তবে সবশেষে আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তির সঙ্গে যান্ত্রিক হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই, বরং প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানবিক হয়ে উঠতে পারার মধ্যেই প্রকৃত সফলতা।
লেখক: প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, নোয়াপাড়া কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম।