ফ্যাসিবাদীদের বাদ দিয়ে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে

চট্টগ্রামে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ আন্দোলনে হামলা ও গুলির সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২০ অক্টোবর, ২০২৪ at ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে ফ্যাসিবাদী দোসরদের বাদ দিয়ে সকল দলের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। একইসাথে খেয়াল রাখতে হবে যাতে বিগত সরকারের মতো একই ধারণার মানুষগুলো আবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে না পারে। যাতে তাদের হঠাতে আবারও গণঅভ্যুত্থান না হয়। কারণ সকল দলের অংশগ্রহণে ব্যবসায়ী সংগঠন পরিচালিত হলে ব্যবসায়ীরা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারবে। গতকাল শনিবার বিকালে নগরীর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, এসোসিয়েশন, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক প্রতিনিধির সাথে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এ সরকার প্রভাবিত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব কোনো লোক নেই। আবার আমরা প্রভাবিত নই। বিগত সরকারের সময়ে দখলঅপদখলের কারণে বাণিজ্য সংগঠনগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি। দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো চিহ্নিতপূর্বক তা সমাধান করে কার্যকরী করার জন্য প্রশাসককে সহায়তা করার আহ্বান জানান তিনি। ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প ও অর্থ সংক্রান্ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনে উপদেষ্টামণ্ডলীর সাথে আলোচনা করে সমাধানের আশ্বাস দেন তিনি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কৃষকদের থেকে সরাসরি পণ্য সংগ্রহ করে ভোক্তা পর্যায়ে ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহের জন্য সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানান তিনি।

সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা চিহ্নিতভাবে হামলা ও গুলি করার সঙ্গে জড়িত তাদের অতি দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে। কিছুদিন পর আপডেট নেব কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চট্টগ্রামে গতকালও পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শক্তির লোকজন স্লোগান দিয়েছে। চট্টগ্রামে তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য বলেছি। যারা এর আগে বিভিন্ন অন্যায়ের সঙ্গে, হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি স্টেডিয়ামগুলো পরিদর্শন করেছি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তাদের নিয়ে এসেছি, যাতে তারা দেখতে পান কী কী সংস্কার প্রয়োজন। ঢাকা ও সিলেটে বিপিএলের তিনটি স্টেডিয়ামের সংস্কারের জন্য ৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়ে গেছে। ভালো বিপিএল আয়োজন করতে চাই। ভালো অভিজ্ঞতা দর্শকদের দিতে চাই। যে সংস্কারগুলো না করলেই নয় সেগুলো তিনটি স্টেডিয়ামেই করব। প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশনা দিয়েছেন কীভাবে একটি ভালো বিপিএল আয়োজন করতে পারি। প্রাথমিক কাজ স্টেডিয়াম সংস্কার। সেটি আমরা করব। চট্টগ্রামের দুটি স্টেডিয়ামের সংস্কার প্রয়োজন। আমি ইতোমধ্যে জেলা ক্রীড়া পরিষদকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছি।

সাকিব আল হাসান সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাকিব আল হাসানের বিষয়টি একটি বিবৃতির মাধ্যমে আমার পেইজ থেকে স্পষ্ট করেছি। আমি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্রীড়াঙ্গনে যেকোনো প্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ যাতে না ঘটে এবং খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই বিসিবিকে পরামর্শ দিয়েছি যে, আপাতত দেশে না আসার জন্য। বিসিবি সে অনুযায়ী কথা বলেছে। নিরাপত্তা কিন্তু এটা না যে, নিরাপদে দেশে এনে খেলানো। দেশে আসলে যদি নিরাপত্তা বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা থাকে, সেটিও আগে থেকে বিবেচনায় নিতে হবে। উভয় দিক থেকে নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবতে হবে।

উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ একটা এঙট্রা অর্ডিনারি সিচুয়েশন হয়েছে। সেটি সবাই জানে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সাকিব আল হাসানের সম্পৃক্ততা ছিল। এ কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখেছি। কেউ এ বিষয়ে অজ্ঞ নয়। সবাই এ বিষয়টা জানে। আন্তর্জাতিকভাবে সবাই জানে। এ বিষয়ে কী থেকে কী হতে পারে অফিশিয়ালি সেটা বিসিবিকে জানাবে। অফিশিয়ালি আইসিসি থেকে জানানোর আগে আমি কিছু বলতে পারি না।

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি একটি ভিডিও দেখেছি। সেখানে হয়তো একজন ছাত্র বলছিলেন যে, ক্রীড়া উপদেষ্টা ভেতরে বলে গেছেন। আমি বিসিবিতে যখন প্রেস ব্রিফিং করি সেখানে আপনাদের সহকর্মীরা (সাংবাদিক) ছিলেন। আমি বিসিবিতে বলেছিলাম, আন্দোলন করা বা মত প্রকাশ করা সবার সাংবিধানিক অধিকার। এটাকে কেউ মিস রিড করে, এটার মিস লিডিং কোনো বক্তব্য দেয়, সেটার দায় কিন্তু আমার না। আন্দোলন করা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। আমরাও আন্দোলন করেছি, অভ্যুত্থান করেছি। তারপরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে।

তিনি বলেন, বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ভাঙার জন্য সরাসরি কৃষক বা উৎপাদক থেকে এনে বাজারজাত করার কথা বলছি। এটা ব্যবসার সুযোগ। এর মধ্যেও ব্যবসা আছে। এতে গ্রাহকরা ন্যায্যমূল্যে পণ্য পায়। পুরো বাংলাদেশে পজেটিভ সংস্কারের কথা বলছি। ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান এ ধরনের সামাজিক ব্যবসা করতে পারেন। এটা আপনাদের প্রমোশনে ভূমিকা রাখবে। ব্যবসার মধ্যেও যেন জনগণ উপকৃত হয়, ন্যায্যমূল্যে পণ্য পায়, সেদিকেও আপনারা খেয়াল রাখবেন।

আসিফ মাহমুদ বলেন, একটা ঐতিহ্যবাহী জায়গা চট্টগ্রাম চেম্বার। আপনাদের দাবি আমি নোট নিয়েছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলব যাতে সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়। বিগত সময়ে শুধু সদিচ্ছা না থাকায় হয়নি। এ জায়গাগুলো অতিমাত্রায় রাজনৈতিক করে রাখা হয়েছে, পারিবারিকভাবে শোষিত হয়েছে। যদি সবার অংশগ্রহণ থাকত তাহলে আমি বিশ্বাস করি অর্ধেক সমস্যা সমাধান করে ফেলতে পারতেন। আমাদের সময়ে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করব। আমাদের নিজস্ব সংগঠন নেই, নিজস্ব লোক নেই। আমরা প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক করতে সচেষ্ট থাকব। প্রশাসনকে পরামর্শ, তথ্য দিয়ে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবেন। এসব জায়গায় নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমস্যা আগের সদস্য, কাউন্সিলররা রয়ে গেছেন। বাণিজ্য, শিল্প, অর্থ, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে কথা বলব। আন্তঃমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সমস্যা নিরসন সময়সাপেক্ষ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে যায়। আপনারাই বলছেন, বিগত সরকারের সময় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে দখল, অপদখল করায় প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব হয়নি। ভবিষ্যতে যেন একই অনুশীলন না হয়। আমরা বাংলাদেশে এ ধরনের পরিস্থিতি আর কখনো চাই না। ফ্যাসিবাদী দোসরদের বাদ দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলতে পারলে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হবে না। ব্যবসায়িক শ্রমবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবেন। আপনাদের প্রস্তাব লিখিত আকারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কিংবা আমার মন্ত্রণালয়ে দিতে পারেন।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ও চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রশাসক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশার সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান এবং চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম।

শ্রম সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, আজকের অনুষ্ঠানে উত্থাপিত সমস্যাগুলো চিহ্নিতপূর্বক সমাধানে কাজ করা হবে। আমাদের মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সমস্যা সমাধানে খুবই আন্তরিক। এছাড়া বন্দর ও কাস্টমস সংক্রান্ত সমস্যাগুলো নিরসনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে বৈঠকের মাধ্যমে সুরাহা করা হবে। একইসাথে তিনি চট্টগ্রামের সামগ্রিক ব্যবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলো সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে লিখিত আকারে তুলে ধরার আহ্বান জানান।

বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামে বিএসটিআইয়ের উন্নত ল্যাব থাকার পরও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের পণ্যের পরীক্ষার ক্ষেত্রে এখনও ঢাকায় যেতে হয়। ব্যবসায়ীদের সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে বিএসটিআই আগামী ডিসেম্বর ও জানুয়ারির মধ্যে সকল পরীক্ষা চট্টগ্রাম থেকে সম্পন্ন করবে।

চেম্বার প্রশাসক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা বলেন, সরকার আমাকে চট্টগ্রাম চেম্বারে একটি সুন্দর ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য দায়িত্ব প্রদান করেছে। সকলের সহযোগিতা নিয়ে সেই দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করতে চাই। দায়িত্ব নিয়ে আমি সদস্য নবায়ন ও আবেদনের ক্ষেত্রে অনলাইন এবং প্রতিদিনের হালনাগাদ তথ্য চেম্বার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছি।

সভায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. হাবিবুর রহমান, কমিশনার অব কাস্টমস মো. জাকির হোসেন, চেম্বারের সাবেক সভাপতি সরোয়ার জামাল নিজাম, আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী, প্রাক্তন সিনিয়র সহসভাপতি এরশাদ উল্লাহ, সহসভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর, সাবেক পরিচালক আমজাদ হোসেন চৌধুরী, চট্টগ্রাম ফ্রেশ ফ্রুটস ভেজিটেবলস এঙপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুব রানা, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রমিক দলের সভাপতি এ এম নাজিম উদ্দিন, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি সালামত আলী, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু, উইমেন চেম্বার অব কমার্সের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবিদা মোস্তফা, বঞ্চিত ব্যবসায়ী ফোরামের আহ্বায়ক এস এম সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ, প্রাইম মুভার এসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিম খান, চট্টগ্রাম বন্দর শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক নেতা নুর উল্লাহ বাহার ও নারীনেত্রী শাহানা চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। এছাড়া বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএর নেতৃবৃন্দ এবং ব্যবসায়ী ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

বক্তারা চট্টগ্রাম বন্দরের আওতাধীন আইসিডির অতিরিক্ত চার্জ, ব্যবসায়িক হয়রানি, ট্যাঙ ও ভ্যাটের নামে হয়রানি, ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের এঙেল লোড, বন্দর শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ, শ্রমিকদের টিসিবির মাধ্যমে রেশন কার্ড, বাণিজ্য সংগঠনগুলোতে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ, রুহেলসহ ৯২ জনের নামে মামলা
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬