ফৌজদারী মামলার বিভিন্ন ধাপসমূহ

জেনে নিন আপনার যত অধিকার

জিয়া হাবীব আহ্‌সান | মঙ্গলবার , ১৯ মার্চ, ২০২৪ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

দেওয়ানী অধিকার ও সম্পত্তির অধিকার ব্যতিত যেকোনো অপরাধ ফৌজদারি মামলার অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় দাঙ্গা হাঙ্গামা, ব্যক্তির জীবন হরণ, সাইবার ক্রাইম, অর্থসম্পদ লুটপাট, পাচার, আত্মসাৎ, বিশ্বাসভঙ্গ, প্রাণ নাশের হুমকি, বেআইনি সমাবেশ, যৌন হয়রানি, জালিয়াতি, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান প্রভৃতি অপরাধে যেসব মামলা দায়ের করা হয় তাকে ফৌজদারি মামলা বলা হয়।এসব মামলায় আপরাধী দোষী সাব্যস্ত হলে জেল জরিমানা, যাবজ্জীবন এবং মৃত্যুদণ্ড হয়ে থাকে। সাধারণত ফৌজদারি মামলা দুইভাবে চিহ্নিত করা যায়-ক) আমলযোগ্য মামলা এবং আমল অযোগ্য মামলা।

ক) আমলযোগ্য মামলা: আইন মোতাবেক কিছু অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারবে। এসব ক্ষেত্রে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে থাকেন। এসব অপরাধে যে মামলা হয় তাকে আমলযোগ্য মামলা বলা হয়। আবার আমলযোগ্য মামলাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা: ১) একটি জি আর বা পুলিশি মামলা, অন্যটি ২) সি আর বা নালিশি মামলা।

খ) আমল অযোগ্য মামলা: কিছু অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারে না। অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে সর্বোচ্চ ৬০ দিনের মধ্যে প্রসিকিডিশন ওয়ারেন্ট বা নন-এফআইআর মামলা আদালতে দাখিল করেন। এগুলো আমল অযোগ্য মামলা।এ ধরনের অপরাধের মামলা কোর্টের নন-জিআর রেজিস্ট্রারভুক্ত হয়ে পরিচালিত হয় বলে এ মামলাকে নন-জিআর মামলা বলা হয়।

নালিশি বা সিআর মামলা: ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে সরাসরি গিয়েও কোর্ট ফি দিয়ে বিচার প্রার্থনা করা যায়। ফৌজাদারী কার্যবিধির ১৯০ ধারা মতে ম্যাজিস্ট্রেট সি আর মামলা গ্রহণ করে থাকেন এবং ২০০ ধারা মতে নালিশকারীকে হলফপূর্বক জবানবন্দী গ্রহণ করে মামলা রুজু করেন। সি আর মামলা গ্রহণের পর ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন যে অভিযোগ সম্পর্কে সন্দেহ আছে তাহলে তিনি সে মুহূর্তে মামলা গ্রহণ করে ২০২ ধারা মতে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করে ১৭৩ ধারা মতে আদালতে রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্ট পাওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেট যদি দেখেন যে ঘটনার সত্যতা নেই তাহলে তিনি ২০৩ ধারা মতে মামলা খারিজ করে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে পুনঃতদন্ত চেয়ে নালিশকারী চাইলে নারাজী দাখিল করতে পারে অথবা ম্যাজিস্ট্রেট নিজে চাইলেও পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন। এরপর ধাপে ধাপে মামলার বিচার শুরু হয়, রেজিস্ট্রার মামলা নথিভুক্ত করে পরিচালিত হওয়ার কারণে এগুলোকে সি আর মামলা বলা হয়।

পুলিশি মামলা: থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে এজাহার দায়েরের মাধ্যমে যে মামলা শুরু হয় তাই পুলিশি মামলা নামে পরিচিত। পুলিশি মামলাকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হলো ক) জিআর, ও খ) নন জিআর মামলা।

ক) জিআর মামলা: জি.আর (এ.জ) মানে জেনারেল রেজিষ্ট্রার, থানায় যেসকল মামলা হয় তা জি আর (GR Case)। ফৌজদারী কার্যবিধির তফসিল অনুযায়ী দণ্ডবিধির যেসব অপরাধ আমলযোগ্য সেসব অপরাধ কোন থানার এখতিয়ারাধীন এলাকায় সংঘটিত হলে থানা সরাসরি মামলা নিতে পারে যা জি আর কেইস। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৪ ধারা মতে সাধারণত একটি জি আর মামলা শুরু হয় এফ.আই.আর (প্রাথমিক তথ্য বিবরণী) মাধ্যমে। জি আর মামলায় ১৫৬ ধারা মতে পুলিশ তদন্ত করে থাকেন। যা ফৌজদারি কার্যবিধির এই ধারা অনুসারে জি.আর কেস ফাইল হলে পুলিশ তৎক্ষণাৎ তদন্ত করে কিংবা অভিযোগের প্রাইমাফেসি (যা ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা) নির্ধারণ করে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারেন, কোনওরকম আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই। সি.আর মামলায় আদালত সাধারণত তদন্ত শেষে সমন বা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে কেবল তা কার্যকর করা যায়। আইনের মতে সকল ধরণের আমলযোগ্য অপরাধ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ সুতরাং সকল ক্রিমিনাল কেস এ বাদী রাষ্ট্র।

খ) নন জিআর মামলা: আমলযোগ্য মামলা সংঘটিত হওয়ার সংবাদ পেলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সেটিকে এজাহার হিসেবে গণ্য না করে সাধারণ ডায়েরি বা জিডি হিসেবে রেখে পুলিশি প্রবিধান ৩৭৭ অনুসারে জিডি এন্ট্রি করে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে বিষয়টি তদন্ত করে আদালতে নন-এফআইআর প্রসিকিউশন রিপোর্ট দায়ের করতে পারেন। এগুলো নন-জিআর মামলা নামে পরিচিত।

জিআর ও সি.আর মামলায় জামিন: জামিন একজন অভিযুক্তের ন্যায্য অধিকার। যখনি কারো বিরুদ্ধে সি আর অথবা জি আর মামলা হয় তাৎক্ষণিকভাবে তাকে কেবল অভিযুক্ত বলা যায় অপরাধী নয়। কারো বিরুদ্ধে মামলা হলেই সে অপরাধী বলা যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত তাকে শাস্তি না দেয়। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৬ ধরায় জামিন সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। ফৌজদারী কার্যবিধির তফসিলে উল্লেখিত যেসব অপরাধ জামিনযোগ্য আদালত সেসব অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন দিবেন। ফৌজাদারী কার্যবিধির তফসিলে দণ্ডবিধির কোনও কোনও ধারা জামিনযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য সে সম্পর্কেও বলা আছে। পাশাপাশি অন্যান্য বিশেষ আইনগুলোতেও জামিন বিষয়ে নিজস্ব বিধান দেওয়া থাকে। একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বলে রাখা উচিৎ যে জামিন সম্পর্কে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় বলা হয়েছে জামিন অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত কোন ব্যক্তি গ্রেফতার হলে বা কোনও থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার কর্তৃক বিনা পরোয়ানায় আটক থাকলে অথবা আদালতে হাজির হলে বা তাকে হাজির করা হলে, তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া যেতে পারে, কিন্তু সে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনও অপরাধে অপরাধী বলে বিশ্বাস করার মত যুক্তিসংগত কারণ থাকলে তাকে উক্তরূপে মুক্তি দেয়া যাবে না। তবে শর্ত এখানে আরও বলা হয়েছে যে, জামিন অযোগ্য কোনও অপরাধে অভিযুক্ত কোনও ব্যক্তি ষোল বৎসরের নিম্ন বয়স্ক বা স্ত্রীলোক বা পীড়িত বা অক্ষম হলে আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দিবার নির্দেশ দিতে পারবেন। ৪৯৭ ধারার (২) উপধারায় বলা হয়েছে তদন্ত অনুসন্ধান বা বিচারের কোনও পর্যায়ে উক্ত অফিসার বা আদালতের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, আসামী কোনও জামিন অযোগ্য অপরাধ করেছে বলে বিশ্বাস করার মত যুক্তিসংগত কারণ নাই, তবে তার প্রতীয়মান হয় যে, আসামী কোনও জামিন অযোগ্য অপরাধ করেছে বলে বিশ্বাস করার মত যুক্তিসংগত কারণ নাই, তবে তার দোষ সম্পর্কে আরও তদন্তের পর্যাপ্ত ভিত্তি রয়েছে, তাহলে এরূপ তদন্ত সাপেক্ষে আসামীকে জামিনে অথবা উক্ত অফিসার বা আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতায় অতঃপর বর্ণিতভাবে সে হাজির হবার জন্য জামিনদার ব্যতিত মুচলেকা সম্পাদন করলে তাকে মুক্তি দিতে হবে।

ফৌজদারি মামলার ধাপ: ফৌজদারি মামলাগুলো সাধারণত চারটি আদালতে পরিচালিত হয় তা হলো ১) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২) হাইকোর্ট বিভাগ ৩) দায়রা জাজ আদালত ৪) ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে কোনও অভিযোগ আমলে নেওয়া হলে মামলা নিষ্পত্তি পর্যন্ত যে কয়টি ধাপ রয়েছে তাই হচ্ছে ফৌজদারি মামলার ধাপ। তা নিম্নে দেয়া হল:-

১) সমন: আসামী দের বিরুদ্ধে আদালত স্বাক্ষরিত সমন ইস্যু করা হয়। যেখানে আদালতে হাজির হবার জন্য একটি নির্দিষ্ট তারিখ থাকে। আদালত অপরাধ আমলে নিয়ে সরাসরি ওয়ারেন্ট ও দিতে পারেন।

২) ওয়ারেন্ট: সমনে উল্লেখিত তারিখে আসামী হাজির না হলে আদালত তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেন। এরূপ প্রসেস কে ড/অ বা Warrant of Arrest বলা হয়।

৩) Warrant of Proclamation and Attachment: ওয়ারেন্ট এ উল্লেখিত তারিখে আসামীকে হাজির করা না গেলে বা আসামী পলাতক থাকলে আদালত তার বিরুদ্ধে WP & A (Warrant of Proclamation and Attachment) ইস্যু করেন। এটি ʻহুলিয়া্থ বলে পরিচিত। ওয়ারেন্ট আসামীকে ধরে আনতে পুলিশকে দেওয়া হয়।

৪) পত্রিকা বিজ্ঞপ্তিঃ WP & A এতে উল্লেখিত তারিখে আসামীকে হাজির করা না গেলে বা আসামী পলাতক থাকলে এবং আদালত তার বিরুদ্ধে দুটি বহুল প্রচলিত বাংলা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রদানের আদেশ দেন।

৫) অনুপস্থিতিতে বিচার : পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রদানের পরও উল্লেখিত তারিখে আসামী হাজির না হলে বা আসামী পলাতক থাকলে তার অনুপস্থিতিতে বিচার শুরু হয়। একে আইনের ভাষায় (Trial In Absentia ) বলে।

৬) চার্জ শুনানীঃ উপরোক্ত কোন প্রকিয়ায় বা স্বেচ্ছায় অভিযুক্ত ব্যক্তি হাজির হলে আদালত তাদের উপর আনীত অভিযোগ তাদের কে পড়ে শোনাবেন। তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করলে আদালত তার জন্য তাদের কে শাস্তি প্রদান করবেন। অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করলে উহার সত্যতা নিরূপনের জন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণের নিমিত্তে সাক্ষীদের প্রতি সমন এবং ক্ষেত্র বিশেষে অনান্য প্রসেস যেমনঃ hgbt ww ev witness warrant এবং ww বা Non Bailable Witness Warrant ইস্যু করা হয়। তবে চার্জ শুনানীতে যদি আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা নাই তাহলে বিচারে না গিয়ে আসামী/আসামীদের কে অব্যাহতি দেয়া হয়। চার্জ বা ডিসচার্জের বিরুদ্ধে রিভিশন করা যায় দায়রা জজ আদালতে।

৭। সাক্ষ্য গ্রহণ: এই পর্যায়ে ফরিয়াদী পক্ষের এডভোকেট মহোদয় ফরিয়াদী সহ তার মনোনীত সাক্ষীদের জবানবন্দী গ্রহণ করেন এবং আসামী পক্ষ তাদের জেরা করেন।

৮। রায় প্রদান: সাক্ষীদের সাক্ষ্য, নথিস্থ কাগজাত ও অনান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে আদালতের নিকট সন্দেহাতীতভাবে আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনানুসারে শাস্তি প্রদান করেন। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত না হলে খালাস প্রদান করেন।

৯। আপীল: কোনও পক্ষ আদালতের প্রদত্ত রায়ে সন্তুষ্ট না হলে এখতিয়ার সম্পন্ন উচ্চ আদালতে আপীল করতে পারেন। আপীল আদালত নিম্ন আদালতে রায় বহাল রাখবে পারেন, খারিজ করতে পারেন কিংবা পুনঃবিচারের জন্য রিমান্ডে পাঠাতে পারেন।

উপরের ধাপগুলো পার হতে আরো অনেকগুলো বিষয় থেকে যায়৷ যেমন- তদন্ত প্রতিবেদন এর বিরুদ্ধে না-রাজি, পুনঃতদন্ত, বিচারের জন্য প্রস্তুত বা রেডি ফর ট্রায়াল, যেকোনও আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন, ট্রান্সফার মিসকেইস ইত্যাদি।

উপরের আলোচনা থেকে সাধারণ মানুষ আমাদের বিচার ব্যাবস্থায় ফৌজদারী মামলার বিভিন্ন ধাপ বা পর্যায় সম্পর্কে কিছু টা ধারনা পাবেন আশা করি।

লেখক: আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষের জীবন এতো সস্তা কেন
পরবর্তী নিবন্ধডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী