ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রিকভার ও ভেরিফাইড, ফেসবুক পেজ বুস্ট এবং ফলোয়ার বাড়ানোর চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কৌশলে অ্যাকাউন্ট হ্যাক করেন স্বামী-স্ত্রী। এরপর ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি ও ভিডিও সংরক্ষণ করে তা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে শুরু হতো ব্ল্যাকমেইলিং।
সম্প্রতি এমনই একটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। নগরীর হালিশহর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ইউনিটের সাইবার ক্রাইম টিমের হাতে ধরা পড়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনই।
তারা হলেন, হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার ফুল মিয়ার ছেলে আসাদুজ্জামান পলাশ (২১) ও গাজীপুর সদর থানার সারওয়ার হোসেন সরকারের মেয়ে সাদিয়া সরকার (২১)। তাদের হবিগঞ্জ জেলার মাহমুদাবাদ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সাইবার ক্রাইম টিম। হবিগঞ্জ জেলার গোয়েন্দা বিভাগ অভিযানে সহায়তা করে। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে হ্যাকিংয়ের কাজে ব্যবহৃত দুটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, ৬টি ভুয়া রেজিস্টার্ড সিম কার্ড ও একটি মেমোরি কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার দুপুরে সিএমপির দামপাড়া পুলিশ লাইনের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মো. হামিদুল আলম ছাড়াও এ সময় অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন ও ইন্সপেক্টর সঞ্জয় সিনহা উপস্থিত ছিলেন।
মো. হামিদুল আলম বলেন, গত ২৬ নভেম্বর এক গৃহবধূর ছোট বোনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়। তিনি ওই অ্যাকাউন্ট ফিরে পেতে ফেসবুকে বিভিন্ন উপায় খুঁজছিলেন। পরে একটি পেজের সন্ধান পান। ওই পেজে অ্যাকাউন্ট ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয় তাকে। এরপর তানজিলা আক্তার তুলি নামের এক নারী ভুক্তভোগী গৃহবধূকে ফোন করে ১ হাজার ৪০০ টাকা পাঠাতে একটি বিকাশ নম্বর দেন।
বিকাশে টাকা দেয়ার পর ২৮ নভেম্বর রাত ৩টায় তুলি ফেসবুক মেসেঞ্জার থেকে গৃহবধূকে ফোন করেন। বলেন, ফেসবুক ৫ মিনিট সময় দিয়েছে অ্যাকাউন্ট রিকভারি করতে। তবে এজন্য জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট লাগবে জানিয়ে একটি লিংক পাঠানো হয়। ওই লিংকে গৃহবধূর ব্যবহৃত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে লগইন করার জন্য বলেন তানজিলা।
গৃহবধূ ওই লিংকে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও পাসওয়ার্ড দেয়া মাত্রই তার ব্যবহৃত অ্যাকাউন্টও হ্যাক হয়ে যায়। এরপর তিনি অন্য একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে তুলিকে মেসেঞ্জারে ফোন করেন। এ সময় এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি জানায়, গৃহবধূর আইডি সে হ্যাক করেছে। পরে তাকে ওই হ্যাকার অশ্লীল ইঙ্গিত করে মেসেঞ্জারে ভিডিও কল করার প্রস্তাব দেয়।
হ্যাকারের প্রস্তাবে রাজি না হলে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুনতে হয় ওই গৃহবধূকে। হ্যাক হওয়া ফেসবুক থেকে গৃহবধূর স্বামী ও তার ব্যক্তিগত ছবি সংগ্রহ করে তা ইন্টারনেটে ভাইরাল করার হুমকি দেয় হ্যাকার। এমনকি গৃহবধূর ব্যক্তিগত ছবি বিভিন্ন পর্ণ সাইটে ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে।
গৃহবধূর প্রবাসী স্বামী কিছু টাকা পরিশোধ করলে হ্যাকাররা আরও বড় অংকের টাকা দাবি করতে থাকে। টাকা না পেয়ে হ্যাকার হ্যাক করা আইডি থেকে তার বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে ব্যক্তিগত ছবি এবং ভিডিও অশ্লীলভাবে এডিট করে পোস্ট করে। পলাশ ও সাদিয়া দম্পতিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচদিন হেফাজতে নেয়ার আবেদন করেছে পুলিশ।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, পলাশই মূলত বিভিন্ন ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে টাকা নেয়ার কাজটি করেন। তাকে সহায়তা করেন স্ত্রী সাদিয়া। তানজিলা আক্তার তুলি নামের মেয়েটি আসলে সাদিয়া সরকার নিজেই। পলাশের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত মোবাইলে বিভিন্ন নামের ৪৭টি লগইন করা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে।
পলাশ পুলিশকে জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজ থেকে তার এইএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্বাচনী পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তখন তাকে তার বাবা হবিগঞ্জের বাড়িতে নিয়ে যান। ঢাকায় থাকার সময়ে একটি পার্কে সাদিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় তার। বিভিন্ন সময়ে তারা টেলিফোনে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ চালিয়ে যান। পরবর্তীতে তারা বিয়ে করেন।
পলাশ ঢাকায় থাকার সময়ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করেছেন জানিয়ে কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তারা জানান, পলাশ বিভিন্ন ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করেন। টাকা নিয়ে অনেকের আইডি ফেরত দেন। আবার কারোটা ফেরত দেন না।