বর্তমান সময়টাকে বলা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা আর হাতে হাতে স্মার্টফোন মানুষকে করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমমুখী। বিশ্বায়ন আর শিল্পায়নের এ যুগে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। এক হিসেবে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ফেসবুকের নীল জগতে বুঁদ হয়ে থাকেন। মানুষের আবেগ–অনুভূতি, মতামত, বন্ধুত্ব সবকিছু এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে। নানা সামাজিক–রাজনৈতিক পরিবর্তনের নেপথ্যেও এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ শক্তিকে ব্যবহার করে সংঘবদ্ধ চক্র ছড়িয়ে দিচ্ছে নানা ধরনের গুজব। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ফেসবুকে ছড়ানো গুজবে কান দিয়ে বেশ কয়েকটি সহিংসতা এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একটি মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, এমন গুজব ছড়াচ্ছে– যেগুলো শুনে সাধারণ মানুষও ঠিক থাকতে পারে না। বিভ্রান্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা তাই বলছেন, ফেসবুকের ব্যবহার নিয়ে সচেতন হতে হবে এখনই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে গুজব ছড়ানোর বিষয়ে সিএমপির এডিসি (মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ আজাদীকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুযোগ সন্ধানীরা ওঁৎ পেতে আছে। আমাদের সাইবার ক্রাইম ইউনিট এসব অপরাধীর ব্যাপারে সচেষ্ট আছে। তারপরও আমরা যারা ফেসবুক ব্যবহার করি আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। চোখের সামনে কোনোকিছু একটা পড়ল আর অমনি নিজের প্রোফাইলে শেয়ার করে দিলাম এমনটা করা যাবে না। বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে এমন কোনো পোস্ট নিজের প্রোফাইলে শেয়ার করার আগে অবশ্যই তথ্যের সত্যতা যাচাই করে নিতে হবে। এর আগে গত ৬ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি বার্তায় বলা হয়, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৪৮ ঘণ্টায় ৩৫ শিশু শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়েছে। মুহূর্তে পোস্টটি ভাইরাল হয়ে পড়ে। ৩৫ শিক্ষার্থী নিখোঁজ হওয়ার পোস্ট ভাইরাল হওয়ার পর বিষয়টি পুলিশের নজরে আসে। খোঁজ নিয়ে পুলিশ ৩৫ শিক্ষার্থীর নিখোঁজের সত্যতা পায়নি বলে দাবি করে। এ ধরনের পোস্টকে পুলিশের পক্ষ থেকে গুজব বলা হয়েছে। তবে পোস্টটি শেষ পর্যন্ত সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। রোববার (৭ জুলাই) রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ তৎপর রয়েছে। কেউ এ ধরনের গুজব ছড়ালে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এর আগে রাসেলস ভাইপার নামের সাপ নিয়ে দেশজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এই সাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব। কেউ বলছে রাসেলস ভাইপার কামড়ালে অ্যান্টিভেনম নেই, কেউ বলছে চিকিৎসা নেই। অনেকের দাবি রাসেলস ভাইপারই সবচেয়ে বিষাক্ত ও হিংস্র সাপ। পরে গবেষকরা জানান, এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই।
কেন গুজব ছড়াবেন না : সাধারণ বিবেচনায় গুজব ছড়ানো অত্যন্ত অনৈতিক ও গর্হিত কাজ। এটি সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও সহানুভূতির নীতিকে লক্সঘন করে। যে সমাজ নৈতিক ও দায়িত্বশীল কমিউনিকেশনকে মূল্য দেয়, সেখানে গুজব ছড়ানো একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের নীতির বিরুদ্ধে যায়। অনেক সময় গুজব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং তা অনিচ্ছাকৃত পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়ে শত্রুতা উসকে দিতে পারে, দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে। সর্বোপরি মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর ফলে আইনি পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। কেননা, সাইবার স্পেসে মিথ্যা তথ্য বা গুজব প্রতিরোধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির বিধান রয়েছে।
গুজবের শিকার হলে করণীয় : সাইবার স্পেসসহ বিভিন্ন মাধ্যমে রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা, মানহানিকর অশ্লীল ও আক্রমণাত্মক তথ্য ছড়ালে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আইনি প্রতিকার লাভের অধিকার রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, লোকলজ্জা বা অজ্ঞতার ফলে তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বিরত থাকেন। আপনি যদি গুজবের শিকার হয়ে অসম্মানিত হন, তবে পেনাল কোড ১৮৬০ অনুসারে মানহানির মামলা রুজু করতে পারবেন। এছাড়া সাইবার স্পেসে আপনার সম্পর্কে কেউ মিথ্যা তথ্য বা গুজব ছড়ালে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ এর অধীনেও মামলা রুজু করতে পারবেন। এক্ষেত্রে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আইনগত সহায়তা পেতে গুজব প্রচারকারী আইডির লিংক, স্ক্রিনশট ও উপযুক্ত তথ্য–প্রমাণাদি নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।