অভ্যাসবশত টিভির খবরটা নিয়মিত দেখা হতো। অনুশকার অপমৃত্যুর পর তাও বন্ধ করে দিয়েছি। কয়েকদিন থেকে করোনার আপডেটও আর জানতে ইচ্ছে করছে না। এক সময় মেয়েদের দুর্ভোগের ঘটনাগুলো নিয়ে লিখতাম। এখন নৈমিত্তিক ঘটনা হওয়াতে এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে। যেন সব মেনে নিতে শিখে ফেলেছি। খুন, ধর্ষণ, হত্যা এবং নারী। একেবারে সমার্থক শব্দ। সবকিছুতেই একটা বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় নেই। সামাজিক আন্দোলনের জায়গায় হতাশা ভর করেছে। অথচ প্রতিদিন সামাজিক দুর্দশার চিত্রগুলো ভয়ংকরভাবে চোখের সামনে আসছে।
নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অপরাধের জন্ম হচ্ছে। আমাদের দেশের বড় বড় অর্জনের লম্বা ফিরিস্তি। কিন্তু নারী পুরুষের সম্পর্ক এখনও আদিমতার অন্ধকারে ডুবে আছে। যেটুকু মূল্যবোধ তলানীতে গিয়ে ঠেকেছিল তাও বুঝি যায় যায়! অনুশকা দিহান কার তৈরি? কারা ওদের তৈরি করেছে? কে দায় নিবে? পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা সার্বিক পরিবেশ? আমাদের চারপাশটা জুড়ে বড়দের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিত্য প্রদর্শনী। সমাজবদ্ধ মানুষের যুথবদ্ধ বসবাসের প্রতিটি বাড়িতে, পাড়ায় মহল্লায় একটা করে দূরবীন থাকতো। উঠতি বয়স কিংবা যে কারো অসংগত আচরণ ধরা পড়তো, সংশোধনের চাপ থাকতো, ভালমন্দে সুখেদুঃখে প্রতিবেশী ছিল। তখন কিন্তু ব্যক্তিত্বের অমর্যাদা মনে করতো না কেউ। তাই বড় ধরনের আশংকা বা বিপদআপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। মানুষ এখন বড় একা। বড় বেশী বিচ্ছিন্ন। ব্যক্তিত্বের দাপটে মানুষ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে না। তাবৎ সম্পর্কে ব্যক্তিত্বের সংঘাত! যেটুকু সামাজিক মেলবন্ধন দাবি করি তা সোশাল মিডিয়াতেই সীমাবদ্ধ। পাশাপাশি থেকেও আমরা কেউ কাছের হয়ে উঠতে পারি না। আমাদের দেখা প্রতিবেশীগুলো এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না! ঘরের ভেতরও আমাদের বিচ্ছিন্নতা! আমাদের সন্তানটা একাকী ঘরে কি করছে আমরা জানি না প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়ে সন্তানকে একাকী ছেড়ে দিয়েছি। ইউটিউব ওপেন করার সাথে সাথে এত এত অসুস্থ বিষয়ের হাতছানি কেন? পর্নোসাইট এত উন্মুক্ত কেন? অভিভাবকেরা এত উদার কেন? সব বিষয়গুলো এত সহজভাবে নিতে শিখেছি কেন? অনুশকার ময়না তদন্ত শেষে ডাক্তার যে-বিষয়গুলো উচ্চারণ করেছেন তাতে বুঝতে বাকী থাকে না সমাজ এখন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে! বিকিকিনি এখন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাণিজ্যিকিকরণের আর কিছুই বাকী রইলোনা! আমাদের সন্তানেরা না পাওয়ার বেদনা অনুভব করে না। এক দুইটা সন্তান থাকায় মা বাবা সন্তানদের ইচ্ছা অপূরণ রাখতে চায় না। মা বাবা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দূরত্বটাই বড় সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। স্কুল কলেজ কোচিং সেন্টারে পাঠিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা পয়সা খরচ করে দায় সারব সেটা হতে পারে না। আমরা আমাদের সন্তানদের চোখের ভাষা পড়তে জানব না তাতো হয় না! পরিবার হচ্ছে আসল জায়গা যেখান থেকে সন্তানের মূল্যবোধ তৈরি হয়। ভালমন্দ, ন্যায়অন্যায় বুঝার শেখার প্রথম পাঠ পরিবারের কাছ থেকেই পায়। তারপর তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যা পায় তাতে তার বিশ্বাস বোধের জায়গাটা দৃঢ় হয়। সমাজ পরিবর্তনের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন ভেঙ্গে পড়েছে। যার কারণে সমাজে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতায় এসে ভর করছে আমাদের সন্তানদের অপরাধ প্রবণতা ও নেতিবাচক কর্মকাণ্ড। আমরা আমাদের সন্তানদের ভালো একটা পরিবেশ দিতে পারছি না। খেলাধুলার সুযোগ কমে গেছে। বইপড়ার অভ্যাস করানো যাচ্ছে না। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ হচ্ছে না। সুস্থ বিনোদনের সুযোগ নেই। সুতরাং অনুশকা দিহানের পরিণতি এ-পর্যায়ে পৌঁছানো অস্বাভাবিক ভাবার অবকাশ কোথায়? আধুনিকতার দোহাই দিয়ে আমরা যে জীবন বেছে নিয়েছি তা আমাদের জন্য নয়। আমাদের সন্তানদের যতই উড়তে দেই না কেন নাটাই আমাদেরই হাতে থাকতে হবে। ফেলে দেওয়া সমাজের দূরবীনটা আবারও তুলে নিতে হবে। অনুশকাদের পথ চিনাতে হবে। ভালবেসে কাছে থাকতে হবে তারা যেন মিথ্যার আশ্রয় না নেয়। ওদের বুঝাতে হবে ভালবাসা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। জীবনটাও কোন তুচ্ছ বিষয় নয়। প্রেম খুব সুন্দর ও পবিত্র অনুভূতির নাম। মা-বাবা ভাই-বোন বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে একটা প্রেমময় জীবন গড়ে তোলাই জীবনের সার্থকতা।