আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যয় হু হু করে বাড়ছে। ‘টাকা আছে যাঁর, চিকিৎসা তাঁর’ এমন একটি কথা এখন বহুল প্রচলিত। ফলে চিকিৎসা পাওয়া যে প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তা আজকের বাস্তবতায় সর্বাংশে সত্য নয়। বিশেষ করে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্যসেবা এখন মৌলিক অধিকার নয়, বরং একটি সুযোগ, যা কেউ পাচ্ছে, আর কেউ পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণির জনগোষ্ঠীর অসমতা এতটাই তীব্র ও প্রতিকূল যে, সমষ্টিগতভাবে তা দেশের অগ্রগতির অন্তরায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে অর্জিত সাফল্য টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর। সুচিকিৎসা এখনও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে। অর্থাৎ চিকিৎসা শুধু যে উচ্চবিত্তদের, এটা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা চাইলেই দেশের যে কোন হাসপাতালে, যে কোন ডাক্তারের সেবা যখন তখন গ্রহণ করতে পারেন বা চাইলে উড়ালও দিতে পারেন পছন্দের দেশে। এ কথা সত্য যে, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে, যাদের সামান্য কিছু টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই। যারা মধ্যবিত্ত তাদেরও চিকিৎসার জন্য কোন বাড়তি বরাদ্দ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়, বছরে সাত লাখ মানুষ চিকিৎসার ভিসা নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করছে। এতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। বিদেশমুখিতায় সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে ভারতে। প্রতি বছরই বাড়ছে এ হার। আবার ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে বছরে যেসব রোগী চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে তাদের মধ্যে ৩১ শতাংশই ব্যবসায়ী। বাকিদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ৮ শতাংশ, শিক্ষার্থী ১০ শতাংশ, বেসরকারি চাকরিজীবী ২৫ শতাংশ। বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যান্সারের রোগী, ২১ শতাংশ। এরপর ১৮ শতাংশ হৃদরোগ, প্রজননবিষয়ক জটিলতা নিয়ে যাচ্ছে ১৩ শতাংশ। এছাড়া অর্থোপেডিক চিকিৎসা, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, লিভার, কিডনি, চোখ, কান ও স্নায়বিক চিকিৎসার জন্যও বিদেশমুখী হচ্ছে রোগীরা।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী ফ্রন্টিয়ার্সে গত মে মাসে ‘ডিটারমিনেন্টস অব বাংলাদেশী পেশেন্ট ডিসিশন মেকিং প্রসেস অ্যান্ড স্যাটিসফ্যাকশন টুওয়ার্ড মেডিকেল ট্যুরিজম ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে ভারতের হাসপাতালগুলো বছরে প্রায় সাড়ে চার লাখ রোগী পেয়ে থাকে। তবে মেডিকেল ভিসার বাইরেও ভ্রমণ ভিসায় গিয়েও চিকিৎসা নিচ্ছে রোগীদের বড় একটি অংশ। মূলত চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়া, দীর্ঘ সময় অপেক্ষমাণ থাকা, চিকিৎসার সহজলভ্যতার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের রোগীরা বিদেশমুখী হচ্ছে। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বিদেশে গমনকারী বাংলাদেশী পর্যটকদের মধ্যে খুব কম গবেষণা করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে রোগীদের সন্তুষ্টির বিষয়টি এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে বিভিন্ন কারণে দরিদ্র সীমার নিচে চলে যাওয়া মানুষের ২০ শতাংশের কারণ হিসেবে অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয়ই দায়ী। এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাষ্ট্রের ওপর দেশের নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায় থাকলেও বাস্তবে নাগরিকদের চিকিৎসার পেছনে সরকারের খরচ থাকে মাত্র ২৬ শতাংশ। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এখনও অনেকটাই জেলা, বিভাগ এবং শহর কেন্দ্রিক। ফলে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে যাতায়াত ও থাকা খাওয়ার জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর এ কারণে দেশের জনগণের বড় একটি অংশ এখনও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইমেরিটাস অধ্যাপক বলেছেন, চিকিৎসাসেবা পাওয়া জনগণের একটি মৌলিক অধিকার। তাই পথঘাটের ছিন্নমূল মানুষ থেকে শুরু করে শত কোটি টাকার মালিক–সবার জন্যই যথাযথ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। যাদের আয় সীমিত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা যারা দিন এনে দিন খায়, তাদের একজনও যেন বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে এ সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় না নেয়, তা নিশ্চিত করার দায় আমাদেরই। এ বিষয়টা উপলব্ধি করে তা নিশ্চিত করা খুব জরুরি। শুধু সরকার অথবা ডাক্তার নয়, প্রাইভেট হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের মালিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি, ফার্মেসি, চিকিৎসা সহকারী, নার্স, থেরাপিস্ট সকলের সমন্বিত চেষ্টার মাধ্যমেই চিকিৎসা সেবাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় গত কয়েক দশকে অবকাঠামোগত আধুনিকায়ন হলেও রোগীদের আস্থা বাড়েনি। ভুল রোগ নিরীক্ষা, বিশেষায়িত চিকিৎসা না পাওয়া, প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগও দীর্ঘদিনের। অথচ বছরে স্বাস্থ্যসেবার পেছনে যে খরচ হচ্ছে তার ২৪ শতাংশই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে ব্যয় করছে রোগীরা। দেশে চিকিৎসা ব্যয় আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেলেও রক্ষা হচ্ছে না রোগীর অধিকার। যেভাবেই হোক চিকিৎসা–ব্যয় কমাতে হবে।