অন্য একটা রাতের মতোই ফেনীবাসী ঘুমাতে যাচ্ছিলেন। কেউ কেউ যথারীতি সন্ধ্যা রাতেই ঘুমশয্যায়। তবে রাত ১২টার দিকে যারা জেগেছিলেন তাদের চোখে বৃষ্টির ছটাই ছিল তখন। স্বাভাবিক বৃষ্টির আবহের মতোন।
মাঝরাতে দেখলেন বৃষ্টি হচ্ছে। ভোররাতে পানি জমা শুরু করলো আশেপাশে। ঘুমবাসীর তা দেখার সুযোগ নাই।
আর ভোরে? সেই এক ঘনঘটার ভোর। সে সময় বাড়ির উঠোনে জমাট পানি। একটু পরই পানির গৃহপ্রবেশ। কিছু বুঝে উঠার আগেই তা হাঁটু অব্দি। খাটের উপর, চেয়ার–টেবিলের উপর উঠে গেল সব পা। তবে রেহাই মিললো না। পানি দ্রুত বেড়ে কোমর সমান। এরপর গলা ডুবি ডুবি।
এমন দশা দেখতে অভ্যস্ত না ফেনীবাসী। কেউ ভাবতে পারছেন না এমন দশা আদৌ দেখেছেন কিনা! তাই মোকাবিলার কোনো প্রস্তুতি রাখেননি। সাহসও হারিয়ে গেছে। লাখো মানুষ অপ্রস্তুত পেয়ে পানি হয়ে গেল একতলা ভরা, এমনকি কোথাও কোথাও দোতলাও ছুঁয়েছে। কেন এমন হলো?
আবহাওয়াবিদরা বিজ্ঞান থেকে বলছেন, পশ্চিম দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস দেশের পূর্বাঞ্চলের আকাশে প্রবেশ করে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা লঘুচাপ কক্সবাজার–চট্টগ্রাম হয়ে কুমিল্লা–নোয়াখালীর সীমানায় চলে আসে। আর মৌসুমি বায়ুও এ সময় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই তিন মিলে বিপুল পরিমাণ মেঘ কুমিল্লা–নোয়াখালীর আকাশে স্তরে স্তরে জমা হয়। একসময় তা বিস্ফোরিত হয়ে জনপদে নেমে আসে। আবহাওয়াবিদেরা এটাকে বলছেন মেঘ বিস্ফোরণ বা ‘ক্লাউড ব্লাস্ট’। এই মেঘ বিস্ফোরণের শুরু ১৯ আগস্ট সকালে। এরপর টানা তিন দিন প্রবল বর্ষণ আর উজান থেকে আসা ঢল দেশের পূর্বাঞ্চলকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। ১৯, ২০ ও ২১ আগস্ট এ এলাকায় অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে অতিবৃষ্টি, উজানের ঢল, মেঘ বিস্ফোরণ, ফুলে থাকা সাগর মিলে চর্তুভূজী সমস্যার স্থল হয়ে দাঁড়ায় ফেনী সংলগ্ন এলাকা। এমন অবস্থা এই একবার নয় অনেকবার হতে পারে।
পানি যেদিকে যেভাবেই আসুক তা নিচের দিকে গড়ায়। কিন্তু সমস্যার কথা এই যে, হঠাৎ করে নামা এ ধরনের অতি বৃষ্টির পানি সহজে বের হতে পারছিল না। প্রধান কারণ, নদী–খাল–জলাশয়গুলো ভরাট ছিল। আরো অনেক সহযোগী কারণ দেখতে পাওয়া যায়। যেমন–ফসলের ক্ষেতের নিমিত্তে বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো, পানি চলাচলের পথ আটকে দেয়া, যত্রতত্র অবকাঠামো তৈরি, সীমানা প্রাচীর তৈরি ইত্যাদি।
প্রধান কারণে আগে হাত দিতে হবে। নদী–খাল–জলাশয়গুলো আসল রূপে রাখতে হবে। খনন করে, ড্রেজিং চালিয়ে সচল ও সংরক্ষণ করতে হবে। নইলে আজকে ফেনীতে যা ঘটলো অন্যদিন অন্য কোথাও একই দৃশ্যের অবতারণা হবে। তখন আবারো কয়েকদিন মাতামাতি হবে। বাদলের ভরা দিন পেরিয়ে শুকনো মৌসুম আসবে। মাতামাতি হয়ে যাবে বন্ধ। রয়ে যাবে সমস্যা।
আর সহযোগী কিছু কারণ আছে। আমাদের শৈশবে বাড়ির ভিটাগুলো ছিল উন্মুক্ত। একেকটি বাড়ির ঊঠান ছিল এক একটি খেলার মাঠ। এই ভিটা থেকে ওই ভিটা অবধি দৌড়ঝাঁপের সুযোগ থাকতো। সেই সোনাঝরা শৈশব আর নেই যেন। প্রথম দিকে আইল দিয়ে যা ভাগাভাগি হতো, এখন তা সীমানা প্রাচীর দিয়ে পাকাপোক্ত। কোন দিকের পানি কোনদিকে গড়ায়, কোন দিকে গিয়ে যে পানি আটকায় কারো কোনো বাছ–বিচার নাই। পাশাপাশি অধিক ফসল উৎপাদনের নিমিত্তে যে যার মেধা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কোথায় পানি আটকে গিয়ে বিপদ আনবে, কোন জায়গায় ভরাট হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে সেদিকে তেমন খেয়াল নেই কারো।
গ্রাম এখন আগের চেয়ে বেশ সচ্ছল। এর প্রতিচ্ছবি দেখা যায় মাটি, বাঁশ, টিন ইত্যাদিতে তৈরি ঘরের চেয়ে পাকা দালান বেশি গড়ে উঠছে। আর এইসব পাকা দালান মানেই যেন একেকটা পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতা। যে যার মতো করে অবকাঠামো গড়ে তুলছেন। পরিবেশগত দিক কেউ হিসেবে রাখছেন না। এমনকি ভবিষ্যতে কোনো সমস্যায় পড়তে হবে কিনা তাও কারো জানা নাই। এতে করে গ্রামীণ অঞ্চলে বন্যা, জলাবদ্ধতা আরো মারাত্নকহারে বেড়ে যাচ্ছে।
উপরোক্ত সমস্যা সমাধানে কাজ করতে পারেন দক্ষ অঞ্চল পরিকল্পনাবিদরা। কোন জায়গায় কি করা যাবে, কোন ধরনের স্থাপনা করা যাবে না, পানির স্বাভাবিক প্রবাহ কীভাবে বজায় রাখা যাবে, উন্মুক্ত জায়গা কেমন হবে, পুকুর–জলাশয়গুলোর সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে পরিকল্পনাবিদরা ভূমিকা রাখতে পারেন।
বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অঞ্চল পরিকল্পনা নিয়ে উচ্চ শিক্ষা–গবেষণা হচ্ছে। সেখান থেকে পাসকৃত গ্রাজুয়েট কিংবা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে আঞ্চলিক পরিকল্পনা গড়ে তোলা যায়। গ্রামীণ উন্নয়নকে টেকসই করে গড়তে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। একেকটি সুন্দর গ্রামীণ মাস্টার প্ল্যান একেকটি পরিকল্পিত, টেকসই সুন্দর গ্রাম গড়ে তুলতে পারে। আর অনেকগুলো সুন্দর গ্রাম মিলেই গড়ে উঠতে পারে সুন্দর বাংলাদেশ।
লেখক: উপ–পরিচালক (জনসংযোগ),
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।