গাজা ভূখণ্ডকে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে জীবনধারণের প্রয়োজনী রসদ বন্ধ করে দিয়ে সেখানে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ চলছে। দুই সপ্তাহ ধরে এমন অভিযানে তৈরি হয়েছে তীব্র মানবিক সংকট। এর ফলে গাজাবাসীর সময় ফুরিয়ে আসছে। গাজার শরণার্থীদের জন্য কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ গাজার পরিস্থিতিকে নরকের সঙ্গে তুলনা করেছে।
এদিকেব গাজায় শত শত বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আশ্রয় নেওয়া একটি গ্রিক অর্থোডঙ গির্জায় বৃহস্পতিবার রাতে ইসরায়েলি বিমান হামলা হওয়ার কথা জানিয়েছেন দ্য অর্থোডক্স প্যাট্রিয়ার্কেট অব জেরুজালেম কর্তৃপক্ষ ও ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। গাজার হামাস পরিচালিত সরকারি গণমাধ্যম জানায়, বিমান হামলায় ১৮ জন খ্রিস্টান ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। তবে গির্জা থেকে মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে কোনও কিছু জানানো হয়নি। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বলেছে, গেরিলা কমান্ড সেন্টারে বিমান হামলায় গির্জার একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা এখন ৩৭৮৫ জন।
সময় ফুরিয়ে আসছে : দুই সপ্তাহ ধরে চলা সংঘাতের মধ্যে ফিলিস্তিনের ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অনেকে স্কুলের ভবন ও শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। বিছানা–তোষক নেই, ঘুমাতে হচ্ছে মাটি বা মেঝেতেই। তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে খাবার পানি ও চিকিৎসার।
গাজাবাসীর দুর্দশা বর্ণনা করে ইউএনআরডব্লিউএ কমিউনিকেশন ডিরেক্টর জুলিয়েট টুমা বিবিসিকে বলেন, ‘তাদের জন্য সময় ফুরিয়ে আসছে’। গাজাকে ‘নরকের গর্তের’ সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, সময় ফুরিয়ে আসছে। প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে। দীর্ঘ এই সময় ধরে ইউএনআরডব্লিউএ গাজায় কোনো সহায়তা প্রবেশ করাতে পারেনি। ঘড়ির কাটা টিকটিক করছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য কখন রাফাহ সীমান্ত পয়েন্ট খুলে দেওয়া হবে সেটি নিশ্চিত নয় বলে জানান টুমা।
ফিলিস্তিনের নিবন্ধিত শরণার্থীদের জন্য সেখানে কাজ করে আসছে জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ বা ‘ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্ক এজেন্সি’। চলমান যুদ্ধে গাজার অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে সেখানে মানবিক সহায়তার দরজাগুলো খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইউএনআরডব্লিউএর কমিশনার জেনারেল লাজারিনি। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গাজায় সাহায্য পাঠানো না গেলে সেখানে মানবিক বিপর্যয় ঘটবে বলে আগেই সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার আগে প্রতিদিন ত্রাণ সাহায্য নিয়ে ৫০০ ট্রাক প্রবেশ করত গাজায়। জ্বালানিসহ অন্যান্য ত্রাণ পৌঁছে দিত ট্রাকগুলো। এখন সেটিও অনিশ্চিত। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, মিশর ও গাজার মধ্যে রাফাহ সীমান্ত পয়েন্টে মিশরের অংশে ৫০টি লরি সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষমাণ। তবে কবে সেগুলো ঢুকবে সেটি নিশ্চিত নয়। চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে এখন কী পরিমাণ সাহায্য দরকার এবং কী পরিমাণ সাহায্য পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেটি অস্পষ্ট বলে জানান ইউএনআরডব্লিউএ প্রধান। তবে গাজাবাসীর জন্য এখন অন্তত প্রতিদিন ১০০ ট্রাক সাহায্য পাঠানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
গির্জায় হামলা : ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা বলেছেন, অন্তত ৫শ মুসলিম এবং খ্রিস্টান ইসরায়েলের বোমা হামলা থেকে বাঁচতে গির্জাটিতে আশ্রয় নিয়েছিল। অর্থোডস্ক গির্জা এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘দ্য অর্থোডঙ প্যাট্রিয়ার্কেট অব জেরুজালেম কর্তৃপক্ষ গাজায় গির্জা চত্বরে হামলার ঘটনার কঠোর নিন্দা জানিয়েছে।’ গির্জায় হামলাস্থলের ভিডিওতে দেখা গেছে, রাতে আহত একটি বালককে ধ্বংসস্তুপ থেকে বের করে নিয়ে আসা হচ্ছে। উদ্ধার কর্মীরা জানায়, উপরের তলায় ২ জন বেঁচে গেছে। আর নিচের তলায় যারা ছিল তারা মারা গেছে, নয়ত এখনও ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে আছে। গাজার ২৩ লাখ অধিবাসীর আনুমানিক ১ হাজার জনই খ্রিস্টান। তাদের বেশির ভাগই গ্রিক অর্থোডঙ। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বলছে, তারা গির্জার কাছের একটি কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টারে বিমান হামলা চালিয়েছে। ওই সেন্টার থেকে ইসরায়েলে হামলা চালানো হত। ‘কমান্ড সেন্টারটিতে আইডিএফ এর হামলার ফলে ওই এলাকায় অবস্থিত গির্জাটির একটি দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে হতাহতের ঘটনা সম্পর্কে আমরা অবগত। ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে,’ বলেছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী।
গাজায় নিহত বেড়ে ৩৭৮৫ : ইসরায়েলের হামলায় গাজা উপত্যকায় সব শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিন হাজার ৭৮৫ জনের প্রাণ গেছে। আর আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৪৯৩ জন। গতকাল ২০ অক্টোবর এই খবর জানায় আল জাজিরা। ইসরায়েলের হামলায় গাজায় নিহতদের মধ্যে অন্তত এক হাজার ৫২৪ শিশু। এর মধ্যে এক হাজার নারীও রয়েছেন। প্রাণ গেছে ১১ সাংবাদিকের। আর আহতদের মধ্যে রয়েছে দুই হাজার শিশু। নারীর সংখ্যা এক হাজার ৪০০। এদিকের হামাসের হামলায় এক হাজার ৪০৩ ইসরায়েলির প্রাণ গেছে। এর মধ্যে ৩০৬ ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সদস্য, ৫৭ পুলিশ সদস্য রয়েছেন। আর নিখোঁজ প্রায় ১০০। আহত হয়েছেন চার হাজার ৬২৯ জন। হামাস–ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বসতি স্থাপনকারীদের হামলা বেড়েছে। ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত পশ্চিম তীরে ৮১ জনের প্রাণ গেছে। আহত হয়েছেন এক হাজার ৩০০ জন। গ্রেপ্তার হয়েছেন ৮৬০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি।
হামাস ও পুতিন, কাউকে জিততে দেব না : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, হামাস ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভিন্ন ভিন্ন হুমকির প্রতিনিধিত্ব করে। তবে তাদের সাধারণ হুমকি হলো, তারা প্রতিবেশীর গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। ওয়াশিংটনের ওভাল অফিস থেকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জো বাইডেন এসব কথা বলেন। ইসরায়েল–হামাস সংঘাতের মধ্যেই তেল–আবিব সফর করে দেশে ফিরে এই ভাষণ দেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা আগের চেয়ে শক্তিশালী। আমেরিকা বিশ্বের জন্য একটি বাতিঘর, এখনও, এখনও। হামাস ও পুতিন, কাউকে জিততে দেব না। সন্ত্রাসী ও স্বৈরশাসকদের মূল্য দিতে হবে।