ফুটপাত দখলমুক্ত হবে?

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১১ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:৩০ পূর্বাহ্ণ

নগরে ২৮১ কিলোমিটার ফুটপাত আছে, যার সিংহভাগ থাকে দখলে। এছাড়া সড়কও স্থায়ী ও ভাসমান হকারদের দখলে থাকে। এতে হাঁটাচলায় অসুবিধা হয় পথচারীর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লাগে সড়কে। যত্রতত্র বসা হকারদের কারণে সৃষ্ট নাগরিক দুর্ভোগের এ চিত্র পুরনো। অবশ্য হকারমুক্ত ফুটপাত কিংবা হকারদের শৃঙ্খলা আনয়নে অতীতে চেষ্টার কমতি ছিল না চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক)। উচ্ছেদের পাশাপাশি হকারদের পুনর্বাসন, ব্যবসা করার জন্য সময় নির্ধারণ এবং তালিকা তৈরি করে পরিচয়পত্র প্রদানের উদ্যোগও নিয়েছিলেন সাবেক মেয়রগণ এবং বর্তমান প্রশাসক। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পুরোপুরি শৃঙ্খলায় আসেনি হকাররা। তাই দুর্ভোগও কমেনি নাগরিকদের। এ অবস্থায় ঘনিয়ে আসছে চসিক নির্র্বাচন। ফুটপাতে নির্বিঘ্নে হাঁটতে না পারা লোকগুলোর প্রত্যাশা, নির্বাচিত মেয়র অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের সমস্যার সমাধান করবেন। বাধাহীন ফুটপাতে নিরাপদ পথ চলার ব্যবস্থা করবেন।
তবে বিষয়টি সহজ নয় বলে মনে করছেন অনেকে। সুলতান আহমেদ নামে এক পথচারী বলেন, ফুটপাত হাঁটার জন্য, ব্যবসার জন্য নয়। আবার দীর্ঘদিন ধরে যারা ফুটপাতকেন্দ্রিক ব্যবসায় জড়িত তাদেরও বিকল্প আয়ের পথ নেই। তাই উচ্ছেদ করলেও ফুটপাতেই ফিরে আসে তারা। তাই দুটো বিষয় সামনে রেখে প্রয়োজন হকারদের শৃঙ্খলায় আনা। নির্বাচিত মেয়রের জন্য এটা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পরবর্তী মেয়র কতটা প্রস্তুত সেটাই দেখার বিষয়।
মেয়র প্রার্থীরা কী বলছেন : আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, হকারদের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ দিতে হবে। তবে সেটা অবশ্যই নিয়মের মাধ্যমে। বিশ্বের অনেক দেশেই হকাররা ফুটপাতে ব্যবসা করে। তবে তারা রাস্তাঘাটে জ্যাম সৃষ্টি করে ব্যবসা করে না। এখন আমরা যদি শহরের হকারদের হঠাৎ করে উচ্ছেদ করি, বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে তাদের পুঁঁজিটা ধ্বংস করে দিই তাহলে তারা যাবে কোথায়? হয় তারা চুরি করবে, অন্যথায় কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, অনেক রাস্তা আছে যেগুলো দিয়ে সবসময় বা খুব বেশি যান চলাচল করে না। এ রকম সড়কগুলোতে হকারদের নির্দিষ্ট সময় বসতে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। এতে জনগণের অসুবিধা হবে না, আবার অনেকগুলো পরিবারও চলতে পারবে। যদি আমরা তাদেরকে একবারে উচ্ছেদ করি তাহলে তারা কিছুদিন পর একই জায়গায় আবার বসে যাবে। এটা কোনো সমাধান না। তাই তাদের একটা নিয়মের মাধ্যমে ব্যবসা করার, পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম শহরে পরিকল্পিত কোনো হকার মার্কেট নাই। জহুর হকার্স মার্কেট ছাড়া আর কোনো মার্কেটই নাই। পরিকল্পিত ব্যবস্থা না থাকায় হকাররা যেখানে সেখানে বসে পড়ে। তাই হকারদের পুনর্বাসন খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্থায়ীভাবে হকারদের উচ্ছেদ করা ঠিক হবে না। তাদেরও তো ব্যবসা করতে হবে। তবে সেটা হতে হবে শৃঙ্খলার মাধ্যমে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এমনকি ভারতেও খণ্ডকালীন হকারদের ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। আমাদের শহরে তো অনেকগুলো মাঠ আছে, যেখানে খেলার সময় বাদ দিয়ে খণ্ডকালীন হকারদের বসার সুযোগ করে দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে তারা আর রাস্তায় বসবে না। আসলে পরিকল্পনামাফিক এগোলে হকার নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
হকারদের শৃঙ্খলায় আনার উদ্যোগগুলো : চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন হকারদের শৃঙ্খলায় আনার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেছেন। হকার নেতাদের সাথে বৈঠক করে বিকাল ৩টা থেকে ব্যবসা করার সময় নির্ধারণ করে দেন। গত পাঁচ মাসে অসংখ্যবার ক্যারাভান কর্মসূচি এবং সরেজমিন পরিদর্শন করে যেখানে-সেখানে বসা হকারদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কিন্তু শৃঙ্খলায় আসেনি হকাররা।
এ বিষয়ে প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন আজাদীকে বলেন, শেরশাহ এলাকায় ৩০-৪০ বছর ধরে সড়ক-ফুটপাতে অবৈধ দখলদার ছিল। মানুষ হাঁটতে পারত না। সেখানে দখলদারমুক্ত করেছি। এর বাইরেও পুরো শহরের ফুটপাতে হকারদের শৃঙ্খলায় আনার জন্য কাজ করেছি। সেখানে ৭০ ভাগ সফল হয়েছি। লোকবলের অভাব এবং কিছু চোর হকার নেতার কারণে পুরোপুরি সফল হতে পরিনি। হকারদের আইডি কার্ড দিতে চেয়েছিলাম। একটা মহল হকারদের কাছ থেকে টাকা খায়। তারা হকারদের সিটি কর্পোরেশন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
২০১৬ সালে নিজ মেয়াদে সর্বপ্রথম হকারদের শৃঙ্খলায় আনার উদ্যোগ নেন তৎকালীন মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন। ওই বছরের ১৩ মার্চ হকারদের দুটি বৃহত্তম ফেডারেশনের সাথে বৈঠক করেছিলেন তিনি। বৈঠকে হকারদের তালিকা প্রণয়ন, পরিচয়পত্র প্রদান এবং স্থান নির্ধারণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে হকারদের বসার জন্য সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। এর আলোকে বৃহস্পতিবার ২টা থেকে, শুক্রবার ও শনিবারসহ সরকারি বন্ধের দিনে পূর্ণ দিবস এবং বাকি দিনগুলোতে গ্রীষ্মকালে বিকাল ৫টা এবং শীতকালে বিকাল ৩টা হকাররা ব্যবসা করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে পথচারীদের চলাচলে জায়গা রাখারও শর্ত ছিল। হকাররা সেটা মেনে নিয়েছিল। কিছুদিন নিয়ম মেনে ব্যবসাও করে তারা। কিন্তু আবারও ফিরে যায় পূর্বের অবস্থায়।
২০১৭ সালের জুন মাস থেকে দুই দফায় ৮ হাজার ৫৯৯ জন হকারের একটি তালিকা করেছিল চসিক। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের পরিচয়পত্র দিতে পারেনি চসিক। ফলে শৃঙ্খলাও আসেনি। এছাড়া রেলের জায়গায় হকার মার্কেট করার অনুমতি চেয়ে স্থানীয় সরকার ও রেল মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দেন নাছির। কিন্তু সাড়া দেয়নি মন্ত্রণালয়।
এর আগে ২০১২ সালে তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমও হকার নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন। একই বছরের ১৮ নভেম্বর হকারদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ৫ সদস্যের লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করে চসিক, যার চেয়ারম্যান ছিলেন মেয়র। কিন্তু হকারদের পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সম্মলিত হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি মো. মিরন হোসেন মিলন আজাদীকে বলেন, হকাররা শৃঙ্খলায় আছে। স্থায়ী হকাররা রাস্তায় বসে না। ভাসমান হকাররা বসে। আমরা পথ পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি। সিটি কর্পোশেনের নির্ধারণ করে দেওয়া সময়ে ব্যবসা করি। তবে চসিক প্রতিশ্রুত আইডি কার্ড পাইনি।
তিনি বলেন, হকাররা এদেশের নাগরিক। তারা যাবে কোথায়? তাদেরও তো পরিবার আছে। আমরা এখন পুনর্বাসনের কথা আর বলছি না। আমরা জাতীয় নীতিমালা চাই। হকার কেন হচ্ছে? অনেক শিক্ষিত ছেলেও এখন চাকরি পাচ্ছে না। উপায় না দেখে তাদের ব্যবসা করছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে
পরবর্তী নিবন্ধশাশুড়িকে গলা কেটে হত্যায় পুত্রবধূর যাবজ্জীবন