প্রশ্ন জাগে তথাকথিত সভ্য দাবী করা ও মানবিকতার ধব্জাধারী পশ্চিমা নেতারা কি দিন দিন অমানবিকতার শীর্ষে চলে যাচ্ছে? পৃথিবীর বুকে কি মানবিকতা শব্দটি নিখোঁজ হয়ে যাবে? চোখের সামনে মৃত্যুর মিছিল দেখলেও আমাদের কোনও প্রতিক্রিয়া জাগে না। আর্তের চিৎকার আমাদের কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। গৎ–বাঁধা জীবনের বাইরে একটা মহত্তর জীবন যে পড়ে আছে তাঁর সুলুক–সন্ধান আমরা কখনও নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। মানবসমাজ, মানবিকতা, মানবাধিকার ইত্যাদি শব্দগুলি প্রচুর শুনি। দেশে ও বিদেশে আন্তর্জাতিক স্তরে এই বিষয় নিয়ে সম্ভবত সর্বাধিক চর্চা হয়, গবেষণা হয়, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সংগঠনও কম তৈরি হয়নি। কিন্তু সেইসব কেতাবি কথাবার্তার আড়ন্বর বোধহয় শুধু সুশীল শিক্ষিতজনের মনন–চর্চার জন্য, বাস্তবে প্রয়োগের জন্য নয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গত ১৬ ও ১৮ অক্টোবর যে অমানবিকতার নাটক অভিনীত হয়ে গেল, তারপরে ওই শব্দগুলো পরিহাসযোগ্য বানানো কথা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।
ফিলিস্তিন–ইসরাইল যুদ্ধ চলছে,এই যুদ্ধ বিশ্বের মানুষকে আর চমকিত করে না। ১৯৪৮ সাল থেকে বিশ্ববাসী এই যুদ্ধ দেখে অভ্যস্ত। তবুও আমরা দাবি করি যে সভ্যতার অগ্রগতি হচ্ছে, পৃথিবী এখন আর আগের মতো নেই। স্থানীয় খণ্ড খণ্ড জাতিসত্তার সীমারেখা ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে পৃথিবী এখন গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি হচ্ছে, পাশাপাশি বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে খণ্ড মানব অপেক্ষা সমগ্র মানবজাতি নিয়ে ভাবনা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং বেঁচে থাকার ন্যূনতম মানবাধিকারের বিষয়গুলি। সবাই জানে যে, যুদ্ধ কখনও বিশ্বমানবের পক্ষে কোনও শান্তিপূর্ণ সমাধান দিতে পারে না। উন্নততর মারণাস্ত্র আবিষ্কার হয়ে চলেছে। ফলে যে–কোনও যুদ্ধ মানেই বেসামরিক হাজার হাজার নিরীহ নর–নারীর হত্যা, চলমান জীবন–যাপনের এক ধ্বংসযজ্ঞ। সেটা কি কারো কাম্য?
ইসরায়েলের পক্ষে আক্রান্ত দেশ হিসেবে আত্মরক্ষার অধিকারজনিত যুক্তি দেখিয়ে হামাস কে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে পূর্ণশক্তি নিয়োগ করা স্বাভাবিক একটি প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো যুদ্ধ জয়ের পরে গাজার কী হবে? হাজার হাজার নির্বিবাদী মানুষ ও মাসুম শিশুর করুণ মৃত্যু ও আর্তনাদের স্মৃতি বুকে আঁকড়ে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আবার দুঃসহ জীবনযাপন হয়তো শুরু হয়ে যাবে! তবে মনে রাখতে হবে গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইয়েলি আক্রমণই কেবল আশঙ্কার বিষয় নয়। অপরিকল্পিত স্বাস্থ্য পরিষেবা, দারিদ্র্যতা এবং বেকারত্বের জ্বালা যন্ত্রণা নিয়ে গাজাবাসীর নিদারুণ কষ্টের জীবন। এই জাতীয় দুর্বিষহ অবস্থা ভবিষ্যতে যে পুনরায় হামাসের উত্তরসূরী তৈরি করবে না কে বলতে পারে? সামরিকভাবে হামাসকে দমিয়ে দেওয়া গেলেও রাজনৈতিক ভাবে হামাস এবং হামাস সদৃশ্য সংগঠনগুলির পুনরুত্থান আদৌ আটকানো যাবো কি? কারণ স্বাধীনতায় কে না বাঁচতে চায়? ফিলিস্তিনির মানবতাবাদী বিখ্যাত কবি মাহমুদ দারবিশ। তিনি তাঁর ‘দ্য প্রোমিজ অব লির্বাটি’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আমি নির্ভয়ে পশ্চিম তীরের রাস্তায় হাঁটছি/ যদিও জলদস্যুরা তখন মদ্যপানে বিভোর/ আমরা আমাদের বন্ধুদের কাছে বসন্তের হাওয়া/ আর শক্রদের কাছে আমরা বারুদ, আগ্নেয়াস্ত্র/ মেরু নক্ষত্রের মতো অনুসরণ করছি পায়ের চিহ্ন।/ একটা মুহূর্তও আমরা হারাতে চাই না; ত্যাগ শ্রম / আর প্রচেষ্টায় নিশ্চিত করতে চাই আমাদের../ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুক্তির পথ /
যতক্ষণ না আমরা ভূমির স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারছি, জেনো আমাদের এই লড়াই চলবে..।’ মাহামুদ দারবিশের কবিতার মতো হামাসও তার শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে ফিলিস্তিনির স্বাধীনতার জন্য হয়ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে! কিন্তু এর পরিণতি কী ভয়াবহ হবে তা আমরা এই মুহূর্তে আঁচ করতে পারছি না !
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতিসংঘ এবং নিরাপত্তা পরিষদ তৈরি হয়েছিল, এই কারণেই যে ভবিষ্যতে কথায় কথায় যুদ্ধ বাঁধিয়ে যেন এরকম রক্তক্ষয়ী গণহত্যা আর না ঘটে, অন্তত যাতে ঠেকানোর চেষ্টা করা যায়। গত অক্টোবরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার পক্ষ থেকে তোলা প্রস্তাবের বক্তব্য ছিল যুদ্ধ–বিরতি না হোক অন্তত মানবিক কারণে অসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ হোক। প্রস্তাবনা নিয়ে যে আলোচনা হয় সেখানে আমেরিকা তো বটেই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং জাপানও বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেছে। যুক্তি কী? না, সেই প্রস্তাবে হামাসের নিন্দা করা হয়নি। বিস্ময়কর বিষয়। এটাই যে এই দেশগুলির ক্ষমতাসীন নেতৃবৃন্দ যুদ্ধ বন্ধ হোক, সংকটে আটকে পড়া নিরীহ অসহায় মানুষজনের কাছে ত্রাণটুকু পৌঁছাক সেটুকুও চান না !
বিস্ময়ের বুঝি সীমা থাকে, তারপরে বিশ্বাস আর কাজ করে না। হতে পারে এটাই বুঝি সেটা। ক্ষমতাধর দেশগুলি ইসরাইল বা ফিলিস্তিনি কোনও–না–কোনও শিবিরে বিভক্ত।
ইতিহাসের কথা সবাই জানে। গত ১০০ বছরে সর্বাধিক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হচ্ছে আরব বনাম ইসরাইল যুদ্ধ। ক্রমশ সেটা মুসলিম বনাম ইহুদি। বর্তমানে সেটা দাঁড়িয়েছে ইসলাম বনাম বাকি বিশ্ব, বিশেষত মার্কিন ছায়াপুষ্ট দেশসমূহ। এখন ইসলাম মানেই উগ্র, সন্ত্রাসী, তালেবান এই ন্যারেটিভ বিশ্বব্যাপি মিডিয়ায় সুপরিব্যাপ্ত। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতি কখনও এক রৈখিক পথ ধরে চলে না। কে কেন কার পক্ষে–তা এক কথায় ব্যাখ্যা করে দাপিয়ে দেওয়া বড় জটিল। তবু বর্তমান যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে যারা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সহানুভূতিশীল তাদের বক্তব্য, গত ৭ অক্টোবরে হামাসের আক্রমণ হচ্ছে অতীব অত্যাচারিত হয়ে কোণঠাসা হতে হতে নিজভূমে ক্রমশ পরবাসী ফিলিস্তিনি মুসলমানদের মরিয়া প্রতি–আক্রমণ। এটা কিছুটা হলেও তাদের পক্ষে যায়েজ, এর জন্য ওদের দোষ দেওয়া চলে না। অপর পক্ষের যুক্তি হলো হামাসের হামলা তো কোনও ঘোষিত ঝগড়ার ফল নয়। এটা তো সন্ত্রাসবাদী আকস্মিক হামলা! হঠাৎ করে শত শত নিরীহ বেসামরিক নর–নারীর উপর বিধ্বংসী নিক্ষেপ করা কি কোনও নীতি–নৈতিকতা দিয়ে একে ব্যাখ্যা করা যাবে? এর প্রতি–আক্রমণ হিসেবে যখন নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে সেটা কেন দোষের হবে? কথার পিঠে কথা চলছে। এতসব কথার পিঠে যা–ই বলা হোক না কেন কিন্তু নিরীহ ফিলিস্তিনি শিশু ও নারীদের প্রতি যেভাবে অমানবিক আক্রমণ ও নির্যাতন করা হচ্ছে তা কি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন নয় ? বিগত পাঁচ দশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি টেকসই শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিনি ও ইসরাইল নামের দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে তাদের সহাবস্থান নিশ্চিত করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ব সর্বতোভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার কারণেই আজকে সমগ্র ফিলিস্তিনির মানবিক পরিস্থিতি শোচনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। আজকে গাজায় ফিলিস্তিনি শিশুরা ইসরাইলি বোমায় নিহত হওয়ার আশঙ্কায় আগেভাগে মা–বাবাকে বিদায় জানিয়ে চিঠি লিখে পকেটে রেখে দিচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সমগ্র বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য লজ্জার বিষয় নয় কি? ইসরাইল যে কৌশলে গাজায় অভিযান চালাচ্ছে, সেটা প্রকৃষ্ট রূপে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনকে লঙ্ঘন। সাধারণ গাজাবাসীকে বিদ্যুৎ, পানি, খাবার, চিকিৎসা, জরুরি ওষুধ পাওয়ার সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, স্কুল, শরণার্থী শিবিরের মতো জায়গায় লক্ষ্য করে বোমা ফেলা হচ্ছে। এটি জেনেভা কনভেনশন ও তার সম্পূরক প্রটোকল গুলোর সম্পূর্ণ বিরোধী নয় কি? গাজায় ইসরাইলের এই অমানবিক ও বিধ্বংসী আক্রমণ নিঃসন্দেহে যুদ্ধাপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয় এবং ইতিহাস এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই।
তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমরা যদি ফিলিস্তিনিদের ভৌগলিক সার্বভৌমত্ব কে স্বীকার না করি। তাহলে আমরা কীভাবে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের পক্ষে কথা বলতে পারি?’ পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা “বিনা কারণে যে একজন নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যা করবে, সমগ্র মানবজাতিকে হত্যার সমান পাপের জন্য তাকে দায়ী হতে হবে”। হাসপাতালের আঙিনাতেই দিতে হচ্ছে গণকবর। এখনো নিশ্চুপ বিশ্ব মোড়লেরা। চোখ থাকতে অন্ধ ও চোখে কালো কাপড় বেধে বিশ্বনেতারা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকবে আর কত দিন? ফিলিস্তিনি সেই শিশুর কথায়, ‘আমি আল্লাহর কাছে গিয়ে বলে দেব’। তারপরও বিশ্ববাসীর কর্ণপাত হবে না!
এখনও প্রতীক্ষায় থাকি, একটা বীর কণ্ঠ উচ্চারিত হবে ‘কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র !’
লেখক : প্রবন্ধিক ও কলামিস্ট ।