আজাদীর সঙ্গে কবে থেকে আমার পরিচয় তা দিন তারিখের হিসেব মেনে বলতে পারব না, যখন থেকে বাংলা বানানে পড়তে জানি তখন থেকেই আজাদীকে চিনি। আমাদের বাড়িতে বেশ কটা কাগজ রাখা হতো, সকালের পত্রিকা হিসেবে সবসময় ছিল আজাদী, পরে পূর্বকোণ আরও পরে নয়াবাংলা। দুপুরে জাতীয় দৈনিক আসতো অন্তত দুরকমের; সংবাদ, ইত্তেফাক, আর ইংরেজি দৈনিক: দ্য অবজার্ভার। এরপরে যুক্ত হলো ভোরের কাগজ এবং তারপরে প্রথম আলোও। রাখা হতো অসংখ্য দেশী–বিদেশী সাময়িকী এবং বিনোদন পত্রিকা। সেইসবে হাত লাগাতে অপেক্ষা করতে হয়েছে কিন্তু আজাদী কেবল পত্রিকা নয় আমাদের অনেকের বেড়ে ওঠার পথের যত সাফল্য, তার বিউগল হয়ে বেজেছে সরবে। আমার বেলায় তো লেখাপড়ার কৃতিত্বই হোক কিংবা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কোনো প্রতিযোগিতার খবর –সবকিছু আজাদীতেই ছাপা হয়েছে ছবিসহ, সবার আগে। আবার ঠিক একইভাবে চাটগাঁ শহরে স্কুলের বন্ধুদের কিংবা বাবামায়ের সূত্রে চেনাজানা যতজন – কে, কী ভালো করল তার খবরও জেনেছি আজাদী পড়ে।
আজাদীর বিশেষ পাতা আগামীদের আসর মানে আমাদের আনন্দের সাম্পান। আমার কাছে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার ছিল আমার পরিচিত অনেকের গল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ– আর আমার এই কিশোরবেলার বন্ধুদের লেখা পড়ে আমারও বিশ্বাস জন্মে গেল যা কিছু আমি মাথায় বুনে চলি সারাক্ষণ তা যদি অক্ষরে সাজাই তবে গল্প হবে নির্দ্বিধায়। সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো আতাউল হাকিম চাচা যিনি এই পাতার দায়িত্বে ছিলেন তিনিও দেখা হলেই বলতেন লিখে ফেল গল্প। দেখতে সুদর্শন অমায়িক মানুষ ছিলেন চাচা। মিষ্টি হেসে বললেও আমি ভড়কে যেতাম, মনে মনে ভাবতাম: কীভাবে চাচা জানলেন যে সত্যিই আমি গল্প মাথায় নিয়ে ঘুরি!
আগামীদের আসর আমাদের সেই ইন্টারনেটবিহীন যুগে বেশ একটা সেলিব্রেটি ভাব এনে দিয়েছিল, কেননা প্রতি শুক্রবার টাইটেল হেডে আমাদের ছবি ছাপা হতো। আমাদের বলতে চাটগাঁ শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সেইসময়ের পরিচিত শিশুকিশোরদের প্রায় সকলের মুখ ছিলো তাতে: ফাহমিদা মালেক, ফাহমিদা নতুন, সেগুফতা কাঁকন, শ্যামলী দাশ (প্রয়াত), কৌশিক শঙ্কর দাশ, আমার ভাই পুষ্পেন, তনুশ্রী দেব, আরো অনেকে। এই পাতা আমার কাছে বাড়িতে আসা অন্য পত্রিকাগুলির শিশু–পাতার চেয়ে বেশি আপন হওয়ার কারণ এটিই। মনে হতো এ আমার নিজের পাতা –নিজস্ব অঙ্গন। কেবল লেখালিখি নয় সেই সময় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজনও করতো আগামীদের আসর। এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী কিংবা অংশগ্রহণকারী অনেকেই পরবর্তীতে জাতীয়পর্যায়েও কৃতিত্ব রেখেছিল।
আমার আগামীদের আসরে সংযুক্তি ক্লাস সিক্সে পড়বার সময়ে হলেও গল্প লিখতে আমি কাটিয়ে দিয়েছি আরও পাঁচ বছর। কেন জানি কাগজ–কলমে লিখতে বসতে আমার দুর্গম পাহাড়সম অনিচ্ছা পেরুতে হতো। আমার গল্প চলতো অবিরাম মগজের খাতায়। সেইসময় মাঝে মাঝে মাকে শোনাতাম– মাও বলতেন লিখে ফেল। কিন্তু লিখতে বসে সময় নষ্ট করে কে? বরং নিজের গল্পের নিজেই শ্রোতা হওয়া ঢের সহজ এবং আনন্দময় । তবে বিষণ্ন কোনো গল্প পড়ে মন খারাপ হলে নিজে নিজেই সেই গল্পের সুখী ইতি টানতে ফাঁকফোকর খুঁজতাম। এই অন্যভাবে গল্পের শেষ হতে পারতো ব্যাপারটা মাকে বললেই বলতেন– লেখো। অবশেষে গল্প আমি লিখলাম। স্কুল ছেড়ে কলেজে পা তখন। তার আগেই আমি কবিতা লিখেছি –সংবাদে ছাপা হয়েছে। তারও আগে ক্লাস নাইনে আমি শিশুদিবস নিয়ে লিখেছি আমার ভাবনা যেটি দৈনিক নয়া বাংলায় প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। প্রতিবারই নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখে চমকে উঠেছি; খুশিতে নয় ভয়ে। মনে হয়েছে কিছুই হয়নি। এ নিয়ে বিশেষ করে আমার বাবার উচ্ছ্বাসে বিব্রত হয়েছি। নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছি। আমি কারও কাছে জানতে চাইনি কেমন লিখলাম কিন্তু আগামীদের আসরে গল্প ছাপার পরে মনে হলো কেউ বলুক কেমন হয়েছে। আমার বাবা চিরকালই আমার সবকিছুতেই উচ্ছ্বসিত থাকতেন বলে আমি বাবার নয় মায়ের মতামতকেই গুরুত্ব দিতাম বেশি। মায়ের প্রচণ্ড বিশ্বাস ছিল আমাকে দিয়ে গল্প হবে। আমার মা আমার কাছে অদ্রিশ বর্ধনের ‘আমার মা সব জানে’র মতো ভরসার জায়গা হলেও তাঁর প্রত্যয়নে আমি লেখালিখিতে কেন জানি আগ্রহী হলাম না। আগামীদের আসরে সেই গল্পের পরে স্বয়ং আতাউল হাকিম চাচাও আমাকে লিখতে বললেও আমি সেই ‘মগজ–মোডেই’ ফিরে গেলাম ফের এমনকি ভুল করেও কোনো খসড়াও মগজ থেকে কাগজে নামাইনি।
আজাদীর আগামীদের আসরে ছাপা আমার সেই গল্পটির নাম ছিল “পুতুল বিয়ে” এবং আমার সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৪৯২। না আমার স্মরণশক্তি অত প্রখর নয়, সেই গল্প আমার বাবা কেটে সযত্নে জমিয়ে রেখেছিলেন, পরে আমি চেয়ে নিয়েছিলাম। দেশ ছাড়ার সময় কত কী ফেলে এসেছি! পরে কুড়িয়ে আনতে গিয়ে দেখেছি যা ফেলে এসেছি তার সবটুকু কুড়িয়ে তোলা যায় না কখনই। সেই গল্পটির পুরোটা নেই, সময়ের ধুলো মেখে মলিন হওয়া খেরো খাতার ফাঁক গলে হারিয়ে গেছে কোথাও। তারপরেও যা আছে তাও আজ অমূল্য ধন। ছাপার অক্ষরে লেখা সে গল্প তো কেবল লেখা নয়, লেখার সঙ্গে লেপ্টে আছে কত বলা না–বলা ক্ষণ।
আগামীদের আসরে প্রকাশিত গল্পটির কথা ছাপার আগে আমার বাবা মা জানতেন না যে আমি আজাদীতে পাঠিয়েছি। আমি বাবাকে দিয়ে পোস্ট করাইনি। ইব্রাহিম চাচাকে দিয়েছিলাম টিকিট এঁটে পোস্ট করতে। ইব্রাহিম চাচা আমাদের দুধওয়ালা। ঠাকুরমার সমস্ত চিঠি তিনিই পোস্ট করতেন। ইব্রাহিম চাচার হাত দিয়ে পোস্ট করানোর কারণ একটিই: গল্প যদি নাও ছাপা হয় আমার বাড়ির কেউ টের পাবে না যে, আমি গল্প পাঠিয়েছিলাম। বাবাকে দিয়ে হাতে হাতে আতাউল হাকিম চাচার কাছে পৌঁছানো যেতো এবং গল্প ছাপা হওয়ার নিশ্চয়তা হয়তো ছিল কিন্তু তেমন হলে গল্পকার রঞ্জনা ব্যানার্জীর জন্ম হতো না আমি নিশ্চিত। আগামীদের আসরের সেই গল্পটি আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল– কখনও চাইলে আমিও গল্প লিখতে পারবো। ত্রিশ বছর পরে আমি সেই আশ্বাসের হাত ধরেই দ্বিতীয় গল্পটি লিখি। মাঝখানের ত্রিশ বছর আমার মগজের ব্যায়ামে অগুন্তি গল্প বুদবুদ তুলে মিলিয়ে গেছে। আগামীদের আসরের “পুতুল বিয়ে” পড়ে যারা আমার গল্পের হাত আছে বলে বিশ্বাস করেছিলেন তারাও এই দুনিয়ার বাসিন্দা নন আর। মজার বিষয় হলো আমার সেই দ্বিতীয় গল্পটি আজাদীতেই ছাপা হয়, ২০১৫ সালে এবং এর পরে আমি আর কলম থামাইনি। সবশেষে বলি, এখনকার রঞ্জনা গল্পকার জেনেই গল্পটি লেখে এবং এই আত্মবিশ্বাসের জায়গাটি আগামীদের আসরেরই নির্মাণ।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।