চিকিৎসার জন্য চার মাস লন্ডনে ছেলের কাছে কাটিয়ে দেশে ফিরলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। সেই উপলক্ষে বিমানবন্দর থেকে গুলশান ১০ কিলোমিটার পথজুড়ে হাজারো নেতাকর্মীর সমাবেশ ঘটিয়ে জনপ্রিয়তা আর সমর্থনের জানান দিল তার দল বিএনপি। গতকাল মঙ্গলবার সকালে বিমানবন্দরে নামার পর নেতাকর্মীদের প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে শুভেচ্ছায় সিক্ত হতে হতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় পৌঁছাতে খালেদা জিয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যায়। ২০১৮ সালে কারাগারে যাওয়ার পর গত সাত বছরে কোনো জনসমাবেশে সশরীরে অংশ নেননি বিএনপি চেয়ারপারসন। এবার তার দেশে ফেরা ঘিরে কার্যত বড় আকারের জমায়েত ঘটাল বিএনপি, যারা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।
বিএনপি নেত্রী ঢাকায় পৌঁছানোর আগে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিমানবন্দরের সামনে বলেন, খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা গণতন্ত্রের উত্তরণের পথকে সহজ করবে। আজ দেশের জন্য ও জনগণের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিন। খবর বিডিনিউজের।
গতকাল সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে বিএনপি চেয়ারপারসনকে বহনকারী এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপর বেলা সোয়া ১১টায় বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়ে গুলশানের বাসায় পৌঁছান দুপুর ১টা ২৬ মিনিটে। এ সময় সড়কের পাশে অবস্থান নেওয়া হাজার হাজার নেতাকর্মী জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা হাতে নিয়ে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানায়। বিএনপি নেত্রী গাড়ি থেকে হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছার জবাব দেন।
বিমানবন্দর থেকে ফিরোজা পর্যন্ত নেত্রীকে বরণ করে নিতে ‘খালেদা জিয়ার আগমন, শুভেচ্ছার স্বাগতম’; ‘তারেক জিয়া বীরের বেশে, আসবে ফিরে বাংলাদেশে’; ‘খালেদা জিয়ার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’সহ বিভিন্ন স্লোগান ধরেন নেতাকর্মীরা।
সোয়া ৭ বছর পর : ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে যেদিন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়, সেদিনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর সোয়া ৭ বছর ধরে লন্ডন থেকে ভিডিও কলেই তিনি দল চালাচ্ছেন। আর দেশে ঝড়–ঝাপটা সামলে বিএনপিকে টিকিয়ে রেখেছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীরসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা।
২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেয়। কিন্তু দুই শর্তের কারণে তিনি কার্যত বন্দি ছিলেন বাসা আর হাসপাতালের জীবনে। রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে তাকে আর দেখা যায়নি। ৫ আগস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি সাজা মওকুফ করে খালেদা জিয়াকে পুরোপুরি মুক্তি দেন। কিন্তু ৭৯ বছর বয়সে নানা অসুস্থতা নিয়ে দলের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তার সরাসরি অংশ নেওয়া হয়নি। চিকিৎসা নিয়ে লন্ডন থেকে তার ফেরার যাত্রা কার্যত রাজনৈতিক কর্মসূচিতেই রূপ নেয়।
দেশে ফেরার যাত্রা : লন্ডনের স্থানীয় সময় সোমবার বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে খালেদা জিয়াকে নিয়ে হিথ্রো বিমানবন্দর ত্যাগ করে কাতারের আমিরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। পথে দোহায় যাত্রা বিরতি দিয়ে উড়োজাহাজটি ঢাকায় পৌঁছায় সকালে। চিকিৎসার জন্য গত ৭ জানুয়ারি লন্ডনে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। লন্ডন ক্লিনিক আর বড় ছেলে তারেক রহমানের বাসায় তার কেটেছে চার মাস। ফেরার পথে তার সঙ্গী হয়েছেন দুই পুত্রবধূ তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথিসহ ১৩ জন।
বিএনপি নেত্রীর সফর সঙ্গীদের মধ্যে আরও ছিলেন তার মেডিকেল বোর্ডের প্রধান শাহাবুদ্দিন তালুকদার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য এনামুল হক চৌধুরী, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল, লন্ডন বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক, সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমেদ। বিমানবন্দরে বিএনপি চেয়ারপারসনকে স্বাগত জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সেলিমা রহমান।
খালেদা জিয়া ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে থেকে গুলশানের বাসায় পৌঁছান সাদা রঙের এসইউভিতে করে। সাধারণত তিনি গাড়ির সামনের আসনে বসেন না, কিন্তু এদিন ব্যতিক্রম দেখা গেল। পেছনের আসনে ছিলেন তার দুই পুত্রবধূ।
খালেদা জিয়ার জন্য গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে ফিরোজা আগেই পুরোপুরি প্রস্তুত করার কথা বিএনপির তরফে জানানো হয়েছিল। ফিরোজায় খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান তার মেজ বোন সেলিমা ইসলাম, ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার, শামীমের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, জোবাইদা রহমানের বড় বোন শাহীনা জামান বিন্দু এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া বিএনপি নেত্রীর মেডিকেল বোর্ডের সদস্য এফ এম সিদ্দিক, বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবর, মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস, সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ ছিলেন সেখানে।
পথে পথে উচ্ছ্বাস : নেত্রীকে বরণ করে নিতে এদিন ভোরের আলো ফোটার পর থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিমানবন্দর সড়কে জড়ো হতে শুরু করেন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী তারা ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কের খিলক্ষেত, কুর্মিটোলা, বনানী, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে অবস্থান নেন। তারা পিকআপ কিংবা বাসে করে গান বাজাতে বাজাতে দলের পতাকা, দেশের পতাকা নিয়ে উপস্থিত হন সড়কে। কেউ কেউ মাথায় দলের পতাকা লাগিয়ে আসেন। কারো হাতে শোভা পায় দলীয় ব্যানার, ফেস্টুন। কোনো কোনো গ্রুপ আসে ব্যান্ডপার্টি নিয়ে।
খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা উপলক্ষে নেতাকর্মীদের ভিড় সামলাতে ঢাকা মহানগর পুলিশও বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার কথা জানায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচলের সুযোগ রাখা হয়। ঢাকা সেনানিবাসের রাস্তায় হালকা যানবাহন চলাচলের সুযোগও থাকে। জনসাধারণকে এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গুলশান–বনানী থেকে উত্তরা পর্যন্ত সড়ক যথাসম্ভব পরিহার করে বিকল্প রাস্তায় চলাচলের অনুরোধ করা হয়। বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর অবস্থানের ফলে কোনো পূর্ব নির্দেশনা না থাকলেও বাধ্য হয়ে বনানী থেকে গুলশানগামী সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নেতাকর্মীদের অবস্থান ঘিরে সড়কে ও বিমানবন্দর এলাকায় বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য, পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন ও আনসার সদস্যকে অবস্থান নিতে দেখা যায়।
লন্ডনের চার মাস : ৭৯ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন থেকে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পাঠানো রাজকীয় বহরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করে গত ৭ জানুয়ারি লন্ডনে যান। সেখানে লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসাধীন ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। টানা ১৭ দিন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি ২৫ জানুয়ারি থেকে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় ছিলেন। লন্ডনে ছেলের কাছে থাকার মানসিক প্রশান্তিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আগের চেয়ে সুস্থবোধ করছেন বলে জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এজেডএম জাহিদ হোসেন।
দুই পুত্রবধূকে নিয়ে পায়ে হেঁটে বাসায় ঢুকলেন : বাংলানিউজ জানায়, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে অনেকটা সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন। দীর্ঘদিনের অসুস্থতায় হুইলচেয়ার নিয়ে চলাচল করা খালেদা জিয়া গতকাল গুলশানের বাসা ফিরোজায় গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান এবং ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথি।
হুইলচেয়ারে চলাচল করা খালেদা জিয়া তখন সবাইকে অবাক করে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে বাড়িতে ঢোকেন, সে সময় তাকে ধরে রেখেছিলেন দুই পুত্রবধূ। এ সময় সেখানে ছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। উপস্থিত বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী তখন স্লোগান দিচ্ছিলেন। খালেদা জিয়াকে হাঁটতে দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তারা। তারা বলছিলেন, গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন। তার নেতৃত্বে আমরা সব বাধা অতিক্রম করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করব।
চিকিৎসায় অনেকটাই সুস্থ : লন্ডনে চিকিৎসার পর শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ আছেন খালেদা জিয়া। গতকাল দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবন ফিরোজার সামনে এক ব্রিফিঙে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, উনি অনেকটা শারীরিক–মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে লন্ডন থেকে ফেরত এসেছেন। চিকিৎসা পরবর্তীতে উনার শারীরিক অবস্থা আলহামদুলিল্লাহ অনেকটুকু উনি সুস্থ আছেন। মানসিকভাবেও উনি স্ট্যাবল আছেন। তবে ১৪ ঘণ্টার (বিমান) জার্নি এবং রাস্তার এই জার্নির কারণে উনি শারীরিকভাবে একটু অবসন্ন। তারপরও মানসিকভাবে উনার অবস্থা অত্যন্ত স্থিতিশীল আছে। খালেদা জিয়ার এই সুস্থতা যাতে অব্যাহত থাকে সেজন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান তিনি। লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে চার মাস পর গতকাল সকালে দেশে ফেরেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক জাহিদ বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন লন্ডনে একদিন কম চার মাস ছিলেন। লন্ডন ক্লিনিকে তার চিকিৎসা হয়েছে। লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। ১৭ দিন ক্লিনিকে থাকার পর তিনি ২৫ জানুয়ারি থেকে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় ছিলেন।
ডা. জাহিদ বলেন, লন্ডনে জ্যেষ্ঠপুত্র বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান ৭ জানুয়ারি উনাকে রিসিভ করা থেকে শুরু করে গতকাল ৫ মে পর্যন্ত উনার লন্ডন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় এবং উনার বাসায় পরিবারের সকল সদস্যের তত্ত্বাবধানে, বিশেষ করে উনার তিন নাতনির কথা বলতেই হয়, ব্যারিস্টার জায়মা রহমান, জাফিয়া রহমান, জাহিয়া রহমান, তারা সব সময় তাদের দাদু অর্থাৎ আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মানসিকভাবে প্রশান্তি দিতে যে দায়িত্ব পালন করেছেন সেজন্য আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে তারেক রহমানসহ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। একইসঙ্গে ইউকে বিএনপির এমএ মালেক, কয়ছর এম আহমেদসহ সকল প্রবাসী বিএনপির নেতাকর্মী এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দলের প্রবাসী নেতাকর্মীরা বিএনপি চেয়ারপারসেনের চিকিৎসার জন্য যে সহযোগিতা করেছেন এবং দেশবাসী সুস্থতার জন্য দোয়া করেছেন, সেজন্য দেশনেত্রী সবার কাছে তার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। আল্লাহর কাছে আমরা শুকরিয়া জানাই তার রহমতে দেশনেত্রী অনেকটা সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসতে পেরেছেন।