ফিউচার

মোহাম্মদ আবদুল মালেক | সোমবার , ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

কয়েকদিন আগের কথা। সিনিয়র ক্লাবে সিনিয়র সিটিজেনদের সভা হচ্ছিল। আমি এই সংস্থার সভ্যদের মধ্যে সবার সিনিয়র; আবার আজাদীর সঙ্গেও সম্পৃক্ত। সম্ভবত বয়স এবং সংবাদ প্রকাশের বিষয়টা বিবেচনা করে আমাকেই করা হলো সভার সভাপতি। সিনিয়র সিটিজেন’স ক্লাবের উদ্যোক্তা ছিলেন আমারই অনুজপ্রতিম বন্ধু লায়ন শামসুল হক (প্রয়াত)। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।

সভা শুরু হলো। উপস্থিত প্রবীণদের কাছে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলাম। অনেকে অনেক কথাই জানালেন। প্রায় সবই দুঃখের কথা।

এর মধ্যে একজনের বক্তব্য আমার মনে বিশেষভাবে রেখাপাত করল। লক্ষ্য করলাম, তাঁর কথার মধ্যে কেমন যেন অনুশোচনা আছে। একটা চাপা কষ্ট আছে। ভদ্রলোক জানালেন, তাঁর এক ছেলে আমেরিকায় থাকে। সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। বললাম, তাতে আপনার অসুবিধা কোথায়? সে তার বউবাচ্চা নিয়ে সুখে আছে। আপনিও আপনার বউ এবং অন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুখে থাকুন।

এবার ভদ্রলোকের কণ্ঠটা বেদনায় আরেকটু ভারী হলো। বললেন, তারা সুখে আছে তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তার পেছনে আমি তো অগাধ টাকাপয়সা খরচ করেছি। তার জন্য কিছু জায়গাজমিও বিক্রি করতে হয়েছে। মনে করেছিলাম, বিদেশ গেলে উপার্জন করে আমাদের দেখাশোনা করবে। ভদ্রলোকের কণ্ঠ এবার আরেকটু করুণ শোনাল। বললেন, ছেলে এখন আমাদের খবরও নেয় না। আর এদিকে বাজারের অবস্থা তো আপনারা সকলেই জানেন। আমার যা আয় তাতে সংসার চালানো দায় হয়ে গেছে।

এ পর্যায়ে আমি তাঁকে থামালাম। জানতে চাইলাম, আপনি আপনার ছেলের জন্যে কী কী করেছেন আগে সেটা বলুন। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটু থেমে বললেন, ছেলের ফিউচারের কথা ভেবে কত কিছুই তো করলাম। ছেলে যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন তাকে দার্জিলিং নিয়ে যাই। ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করাই। ছেলেকে মানুষ করতে হবেএর জন্য নিজের পৈত্রিক জায়গাজমিও বিক্রি করে দিই।

বললাম, আপনি আপনার ছেলের জন্য এই কাজটা এমন এক সময়ে করলেন যখন তার মাবাবার কাছেই থাকার কথা। মায়ের মমতায়, বাবার স্নেহে বেড়ে ওঠার কথা। অথচ ছেলের ফিউচার নিয়ে আপনারা এতই উদ্বিগ্ন, এতই চিন্তিত হয়ে পড়লেন যে, ছেলের বয়সের কথা একবারও ভাবলেন না। এই সেই বয়স, যে বয়সে একজন সন্তানের কাছে সবচেয়ে কাছের মানুষ তার মা ও বাবা। আপনারা সেই বয়সে নিজের সন্তানকে মাবাবা বলে ডাকার অধিকার থেকেই বঞ্চিত করলেন। একবারও চিন্তা করলেন না এই বেড়ে ওঠার সময়টায় তার সবচেয়ে কাছের মানুষ আপনি ও তার মা। ফিউচারের আশায় দার্জিলিং পাঠিয়ে সেদিনই নিজের ছেলেকে হারিয়ে ফেললেন। সেখানে ও লেভেল করার পর তাকে দার্জিলিং থেকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দিলেন হায়ার এডুকেশনের জন্য। আপনি যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। আপনার দুঃখ করার তো কিছু নেই। আপনি তার ফিউচার গড়ে দিতে চেয়েছেন, সেটা আপনি করেছেন।

ভদ্রলোক কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে শুনতে লাগলেন। বললাম, আপনি কি একবার ভেবে দেখেছেন, যেদিন আপনি আপনার ছেলেটাকে বিশেষ লেখাপড়া করার জন্যে দার্জিলিং থেকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দিলেন, সেদিন আপনাদের জন্য যেটুকু মায়ামমতা তার ছিল সেটাও আরও দূরে চলে গেল। এখন আমেরিকায় লেখাপড়া করে, সেখানে বিয়েশাদি করে সংসার নিয়ে সুখেই আছে। আপনার তো সুখী হওয়ার কথা। কারণ আপনি তার ফিউচার চেয়েছিলেন, তা করে দিয়েছেন। এখন বলছেন সে আপনাদের দেখছে না। কখনো ভেবে দেখেছেন, যখন প্রথম দার্জিলিং পাঠিয়েছিলেন সেদিনের সেই ছেলে আর আজকের ছেলে কি এক? দুঃখ না বাড়িয়ে তাই সুখে থাকুন, খুশি থাকুন। আপনি ছেলের যে রকম ফিউচার চেয়েছিলেন তা তাকে করে দিয়েছেন। জীবনে ভবিষ্যতে পাওয়ার আশায় কিছুই করবেন না। তখন তা পেলেও পাওয়ার আনন্দ থাকবে না। জীবনে সুখী থাকার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো আপনার সাধ্যের মধ্যে যদি আপনার চাওয়াটা থাকে তাহলে আপনি তা সহজেই নিজের করে নিতে পারেন। তা হলেই আপনি সুখী হতে পারবেন।

সেই ভদ্রলোককে বললাম, আপনি দুটি ভুল করেছেন। এক : আপনি তাকে ছোটবেলায় দূরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ছোটবেলায় ছেলেকে দূরে সরিয়ে দিলে সম্পর্কের বন্ধনটা হালকা হয়ে যায়। দুই : আপনি ছেলের ফিউচার নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তার কাছ থেকে অনেক আশা করেছিলেন। এখন এসব চিন্তা ছাড়ুন। আপনি তার ফিউচার গড়ে দিয়েছেন, সে চিন্তা করেই সুখী থাকুন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাবেক এমপি নদভীর ৬ দিনের রিমান্ড
পরবর্তী নিবন্ধপবিত্র শবে মেরাজ আজ