
প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাবলিকে গল্পরূপে কলমের কালিতে তুলে এনে ষোলটি গল্প নিয়ে ‘জলের অতলে’ গল্পগ্রন্থটি গল্পকার ফারজানা রহমান শিমুর অসাধারণ এক সৃষ্টি এটা বলতে আমার দ্বিধা নেই। প্রথম গল্প ‘মনু পাগলা’ চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি। নানা ঘাত–প্রতিঘাতে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবক মনু পাগলা। ডেলিভারির সময় প্রিয়তমা স্ত্রী ও সন্তানকে হারায়। সে থেকে মনু একজন পাগল। নানারকম পাগলামির জন্য তাকে সমাজে নিগৃহীত হতে হয়। সমাজের বিবেকহীন মানুষগুলো মনু পাগলাকে সহ্য করতে না পারলেও কিন্তু ছোট্ট রুনের মনে মনু পাগলার জন্য টান অনুভব করে। একদিন মা–বাবাকে সঙ্গে নিয়ে মার্কেট থেকে নতুন জামা কিনে মনু পাগলাকে দেয়। অসহায়দের প্রতি ছোট্ট রুন এর এই ভালোবাসার নিদর্শন আমাদেরকে মানবকতার শিক্ষা দেয়। পাঠকের হৃদয়ে মানবিকতার ছোঁয়া লাগে এখানেই গল্পকার ফারজানা রহমান শিমুর সার্থকতা।
‘কৈশর’ গল্পটি যেন আমাদেরই জীবনের ক্যানভাস। মামা–ভাগ্নের সম্পর্কের এক অপূর্ণ বয়ান। চোখ দিয়ে দেখিয়ে দিলো সব সময় না জেনে না বুঝে ভাবনা করতে নেই। ছোট্ট জাহিদ এক সময় তার প্রাণপ্রিয় মামাকে জীবনের তরে হারিয়ে বুঝতে পারলো মামা তাকে কতটা ভালোবাসতেন।
তূর্যহরণ গল্পটি এক নিরেট প্রেমের গল্প। প্রতিটা দিন এমন হাজারো গল্প রচিত হয় আমাদের চারপাশে। কেউ টিকে থাকে কেউ বা হারিয়ে খুঁজে। তিশা আর তূর্যের প্রেম প্রাপ্তিকে ছুঁয়ে দেয়। একটা সময় গবেট তূর্যটা তীশার সুগন্ধী চুলে নাক ডুবিয়ে ভাবে…কী হবে এর পর?
‘হুল’ গল্পটা লাখ–কোটি মানুষের চাকরি জীবনে নিত্য ঘটে যাওয়া হিসেব গরমিলের কাহিনিকে কেন্দ্র করে লেখা। এখানে এক দুরন্ত প্রেমের ব্যর্থতার কথা উঠে এসেছে। হুট করে একদিন প্রেমিকা নিজ মুখে বিয়ের দাওয়াত দেয়া, বিয়ে অতঃপর একদিন স্বামীর মৃত্যুতে রিক্ত হস্তে সাবেক প্রেমিকের দরবারে চাকরির দরখাস্ত নিয়ে ছুটে আসা। কিন্তু সাবেক প্রেমিক তার বর্তমান সংসারের সুখে মুখ গুজিয়ে থাকা বাস্তবতাকেই মনে করিয়ে দেয়। সময়ের হূল অসময়ে ফুটাতে গিয়ে নির্জীব প্রেমিকা।
কিছু সৎ মানুষের ভিড়ে অসাধু শয়তানদের বিচরণের এক হৃদয় বিদারক কাহিনি ‘পদক’ গল্পটি লেখকের শক্তিমান লেখনির সার্থকতার চূড়ান্ত রূপায়ণ। এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তির লোভকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ক্লাবকে কেন্দ্র করে গজে উঠা কিছু সুযোগসন্ধানী, প্রতারক কর্তৃক সেলিব্রিটি হতে চাওয়া এক লেখককে পদক দেয়ার ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব হাতিয়ে নেয়ার এক গল্পকাহিনী পদক। লেখক দারুণ মুন্সিয়ানায় এমন হাজারো কাহিনির প্রতিচ্ছবি তুলে এনেছে ‘পদক’ গল্পের আড়ালে।
‘ইঁদুর’ গল্পের একটা জায়গায় গল্পকার লিখেছেন, ‘নিত্যদিনের মতো সেদিনও ঢুলছিলো আলতাফ। হঠাৎ প্রচণ্ড চেঁচামিচি তাকে সজাগ করে তোলে। চোখ খুললেই দেখতে পায় পাঁচটি ছেলে ঝাপটে ধরেছে তাদেরই একজনকে আর প্রাণপণে ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছে সে। আলতাফের ভেতরটা ছটফট করতে থাকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখতে পায় কে যেন ছুরি চালিয়ে দিয়েছে ছেলেটার গলায়। গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু করে। আর তার শরীরটা ধপাস করে পড়ে যায় মাটিতে। কেবল খোলা চোখজোড়া নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে আলতাফের দিকে। হিম হয়ে যায় আলতাফ। পরক্ষণে নিজেকে স্থির করে নেয়। চোখ দুটে বন্ধ করে ঝিমানোর ভাব করে। ভয় হয়, বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দটা কেউ শুনে না ফেলে।
অকথ্য ভাষায় খিস্তি খেউর করে ছেলেগুলো অবলীলায় চলে যায় চোখের আড়ালে। চোখ খুলে আলতাফ দেখতে পায়, রক্তের পুকুরে পড়ে থাকা ছেলেটার সামনে গাড়ির গতি থামিয়ে কে যেন ছবি তুলছে। এর পর দুটো বাইক আসে। আরোহীরা বাইক থামিয়ে ভিডিও করে। অসার আলতাফের মাথাটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়।
গল্পকার এই গল্পেরই শেষ দিকে বলতে চেয়েছেন, ‘…ভেতরের রুমে উঁকি দিয়ে আলতাফ দেখে কুটি কুটি করে কাটা এক গাদা কাগজ। মেয়ের চেহারায় চরম বিরক্তি। আলতাফ বলে উঠলো, ইঁদুর ঢুকলো কেমন করে?’ মেয়ে জবাব দিলো, ‘জানি না বাবা, কিন্তু আমার পুরনো খাতাগুলো সব কেটে ফেলেছে। এখন অংকগুলো কোথায় পাবো?’ আলতাফ শিউলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘কি করবি, বল। ইঁদুরের কাজ ইঁদুর করেছে।’ শিউলি মরিয়া হয়ে বলে, ‘আমাদের কাজ আমরা করবো। বিষ দেবো, বাবা। নইলে কেটে সব শেষ করে ফেলবে।’
আলতাফের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। কাটা কাগজগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। আজ যদি সে এগিয়ে যেতো, বাধা দিতো, প্রতিবাদ করতো, হয়তো… নিষ্প্রাণ একজোড়া চোখ তার বুকের ভেতরটাকে কূটকূট, কূটকূট করে কাটতে থাকে।’ এভাবেই শক্তিমান গল্পকার ফারজানা রহমান শিমুর লেখনিতে উঠে এসেছে সমাজের নষ্ট দিক। সাধারণ মানুষকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে প্রেরণা যোগাবে এই গল্প।
বখাট, সন্ত্রাসীদের হাতে প্রতিদিন কত তরুণ–যুবকের প্রাণ যাচ্ছে প্রকাশ্যে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। লেখকের লেখায় ইঁদুর গল্পটিতে সমাজের এক বাস্তবচিত্র ফুটে উঠেছে। ইঁদুর যেমন ঘরের কোণে, অফিসের কোণে প্রয়োজনীয় কাগজ কেটে অনিষ্ট করা থেকে বাঁচতে হয় এমন করে আমরা জনগণ যদি সকল অন্যায় অনাচারকে রুখে দিতে প্রতিবাদী হতাম তাহলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন করে খুন–খারাবি, রাহাজানি আর অনিষ্টতা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়তো না। লেখক ইঁদুর গল্পের অসামান্য শব্দ বুননের মাধ্যমে পাঠকের মনে প্রতিবাদ–প্রতিরোধের বীজ বুনে দিতে চেয়েছেন।
এভাবেই গল্পকার ফারজানা রহমান শিমু তার “জলের অতলে” গল্পগ্রন্থে অসমাপ্ত, ঝিলিক, জলের অতলে, কালোছায়া, লটারি, লজ্জা, মেঘ রোদ্দুর, স্বজন, কমিটমেন্ট, খোলস শিরোনামের গল্পগুলোতে নিত্য ঘটে যাওয়া আমাদের জীবনের নানা প্রতিচ্ছবি লেখনির তুলিতে আঁকার চেষ্টা করেছেন। লেখনির তুলিতে বাস্তবতার ছোঁয়ায় পাঠকের মনকে নাড়া দিতে পারাটাই একজন গল্পকারের সফলতার চূড়ান্ত রূপ। তাই ফারজানা রহমান শিমুর ‘জলের অতলে’ গল্পগ্রন্থটি শতভাগ সফল বললে অত্যুক্তি হবে না। অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ উপলক্ষে ঢাকার চর্চা গ্রন্থ প্রকাশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির মুদ্রিত মূল্য–২০০ টাকা। গল্পকার নিজেই প্রচ্ছদ শিল্পী। দেখতে সাদামাটা মনে হলেও প্রচ্ছদ এর গূঢ় রহস্য ভেদ করা একজন সচেতন পাঠকের কাছে দুরূহ নয়।
লেখক: কবি ও গল্পকার।












