ফাঁকির নাম মিনিকেট চাল

অতিমাত্রায় ছাঁটাইয়ে কমে পুষ্টিমান, ঝুঁকি

| বুধবার , ২৭ জানুয়ারি, ২০২১ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

ফসলের ক্ষেতে মিনিকেট নামে কোনো ধানের অস্তিত্ব নেই। অথচ মিনিকেট নামের চালে বাজার সয়লাব। এই ধান কোত্থেকে আসে, কীভাবে মিনিকেট চাল হয়ে যায়, তা ভোক্তাদের অজানা থাকলেও গত দুই দশক ধরে খাবার টেবিলে তা শোভা বাড়াচ্ছে। কারণ এ থেকে চিকন ও সাদা ভাত হয়।
এই চাল নিয়ে এই অসাধু ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যের ফলে একদিকে যেমন ভোক্তা প্রতারিত হচ্ছেন, অন্যদিকে অতিমাত্রায় ছাঁটাইয়ের ফলে চালের পুষ্টিমান কমে গিয়ে তা শরীরের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান আইনে ধানকে মিনিকেট করা ঠেকানোর কোনো সুযোগ না থাকায় ভোক্তাদের সচেতন হয়ে ওঠাই এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। খবর বিডিনিউজের।
নাম এল কীভাবে? : বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক ড. কৃষ্ণ পদ হালদার বলেন, মিনিকেট নামে কোনো ধানের জাত নেই। ভারতের কৃষকরা এই নাম দিয়েছে। তবে গবেষণাগারে এই জাতের কী নাম দেওয়া হয়েছে, তা আমরা জানতে পারিনি বা জানার চেষ্টা করিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মিনিকেট শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ ‘মিনি’ ও ‘কিট’ থেকে। ভারত সরকার নতুন উদ্ভাবিত কোনো ধানের বীজ ছোট বা মিনি প্যাকেটে কৃষকদের দেয়, তা থেকে কথ্য ভাষায় এই নাম হয়। পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত থেকে কিছু ধানের জাত বাংলাদেশে আসে।
ভারত সীমান্তের কুষ্টিয়া জেলার ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ ঢাকার বাজারে মিনিকেট চালের বাণিজ্যিক প্রচলন ঘটিয়েছেন বলে ব্যবসায়ী মহলে প্রচলিত রয়েছে। তিনি বলেন, ‘মিনিকেট ধান’ বাংলাদেশের ধান গবেষণা কেন্দ্র থেকে আসেনি। মিনিকেট এর জাতের নামও নয়। এই ধানের প্রকৃত নাম যে কী, তা এখনও জানি না।
কেটে হয় মিনিকেট : গত মৌসুমে দেশে ধানের সর্বমোট ফলন ছিল ৩৮৬ লাখ টন; যার মধ্যে কৃষকের কাছে পরিচিত ‘মিনিকেট’ হিসেবে চাষ হয়েছিল মাত্র ৫ লাখ টন। অথচ বছরজুড়ে বাজারে কিংবা অটো রাইস মিলগুলোর সরবরাহ লাইনে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই থাকছে মিনিকেট চাল।
দেশে মিনিকেটের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা রশিদ এগ্রোর প্রতিষ্ঠাতা রশিদ বলেন, আমরা যারা হাস্কার, আমরা প্রথমে ধানের উপর থেকে খোসা ছাঁটাই করি। তারপরে এটাকে হোয়াইটনারে দিয়ে সাদা চকচকে করি। বাজারের চাহিদার কারণে আমরা বাড়তি প্রযুক্তি ও শ্রম ব্যবহার করে চালকে আরও উজ্জ্বল করে থাকি।
বর্তমানে দেশে ১৯ হাজার ৭৩৪টি চালকল বা চাতাল রয়েছে। এদের মধ্যে যারা বৃহদাকারে চালের আন্তঃজেলা বাণিজ্য করে থাকে, তারা সবাই মিনিকেট ব্র্যান্ডের চাল উৎপাদন করে থাকে। উত্তরবঙ্গের মিলগুলোতে ‘মিনিকেট’ ধানের কাছাকাছি মানের ও আকৃতির জিরাশাইল ধান থেকে মিনিকেট চাল করা হয়।
পুষ্টিগুণ কমে যায়? : যশোর, কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ অঞ্চলে সরকারি কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরে কাজ করা একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুধু যে মোটা ধান মেশিনে ঘষে চিকন করা হচ্ছে, তা নয়, বরং মিনিকেট হিসাবে পরিচিতি পাওয়া ধানগুলোকেও উজ্জ্বল ও সুন্দর করার জন্য প্রযুক্তির মাধ্যমে ঘষে চিকন করা হচ্ছে।
ধানের খোসা ছাড়ানোর পর বেশি ঘষে কমিয়ে ফেলা চাল খেলে তাতে ক্ষতিকর হয় কিনা, সে প্রশ্ন করা হয়েছিল ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে কর্মরত বাংলাদেশি চিকিৎসক তাসনিম জারার কাছে। তিনি বলেন, মিলগুলোতে অধিক পরিমাণে ঘষে ফেলার ফলে চালে ভিটামিন, মিনারেল ও ফাইবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান কমে যায়, সেখানে কার্বোহাইড্রেটের বড় একটা অংশ অবশিষ্ট থাকে। মেশিনে চালকে ঘষামাজা করে সরিয়ে দেওয়া ফাইবার কোলস্টেরল স্বল্পতা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, অধিক পরিশোধিত চাল স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আর এভাবেই যেটা পুষ্টির একটা বড় জোগান হতে পারত, সেটা হয়ে যায় স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ।
দায়িত্ব ভোক্তাদেরই : দেশের প্রধান খাবার চালের একটি ধরনে এই ফাঁকি নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারের মন্ত্রীরা কথা বললেও এ নিয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও ‘মিনিকেট’ সমস্যা নিয়ে আপাতত ক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির ওপরেই গুরুত্ব দিচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আরও ৬৮ জন শনাক্ত
পরবর্তী নিবন্ধঅ্যান্টিবায়োটিকের নির্বিচার ব্যবহার বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর ৬ প্রস্তাব