লালনকে আমাদের বাঙালিদের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার যেমন প্রয়োজন নেই, তেমনি প্রয়োজন নেই লালনকন্যা খ্যাত লালনগীতির শিল্পী ফরিদা পারভীনকে। ফরিদা পারভীন বেশ কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু বাঙালিদের মনের মণিকোঠায় লালন সাঁই এবং ফরিদা পারভীন দুটি অবিচ্ছেদ্য নাম। বাঙালিদের হাজার বছরের ইতিহাসে লালন সাঁই এবং ফরিদা পারভীন বাঙালির সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপজীব্য হিসাবে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন। লালন সাঁই একজন মানবতাবাদী আধ্যাত্মিক সাধক। তিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার কুসংস্কার ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানবতাকেই সবার আগে স্থান দিয়েছেন। তাঁর দর্শন শুধু বাঙালিদের নয়, সারা বিশ্বের মানবতাকামী মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর গানের বাণীর যে মর্মাথ তা বিশ্বজনীন। লালন বিখ্যাত তাঁর গানের জন্য। গানের মাধ্যমেই তিনি তাঁর মানবতাবাদী অসামপ্রদায়িক দর্শনের প্রচার করে করে গেছেন। তাঁর যে দর্শন বা অনুভব তা সকলের কাছেই বিস্ময়কর। তাঁর এই বিস্ময়কর প্রভাব ছুঁয়ে গেছে বিশ্বের অনেক বড় বড় মনীষীদের। যেখানে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষ। লালনের গানগুলো যুগে যুগে বহু শিল্পীর কণ্ঠে গীত হয়েছে। এসব গানের তিনি নিজেই ছিলেন গীতিকার সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। তাঁর কাছ থেকে ধীরে ধীরে গানগুলো ছড়িয়েছে বাউল শিল্পীদের কাছে। পরে বিভিন্ন পেশাদার শিল্পীসহ সৌখিন শিল্পীদের কাছে ভীষণ প্রিয় গান হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। লালনের মৃত্যুর শত বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর গানের আবেদন এতটুকু ম্লান হয়নি। বরং লালনের গান নতুন নতুন চিন্তা–চেতনায় আমাদের কাছে আবির্ভূত হয় এবং গবেষণার এক বিস্ময়কর উপাদান হিসাবে দিন দিন তা সামনেই আসে। লালনের গানের ভাষা, শব্দচয়ন ও বিষয় বৈচিত্র্যের নৈপূণ্যতা এক কথায় অসাধারণ। তাঁর গানে মানুষ এবং সমাজ চিত্রের যে রূপায়ন তা যে কোনো সংগীতপ্রেমীদের অনুরাগের খোরাক। লালন সাঁই বিশ্বাস করতেন মানুষের মাঝে বাস করে একটা মনের মানুষ। সেই মনের মানুষের সন্ধান বা খোঁজ পাওয়া যায় আত্মসাধনার মাধ্যমে। সকল মানুষের দেহের ভেতরেই এই মনের মানুষের বাস, যাকে তিনি ‘অচিন পাখি’ বলেছেন। তাঁর গানে গানে সেই কথাই উচ্চারিত হয়েছে‘‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়।’ লালনের গানের মূল ভাবনা মানুষের ভেতরই যে মনের মানুষের বাস রয়েছে, সেই বিশ্বাসকে ধারণ করে বিখ্যাত চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ নির্মাণ করেছিলেন লালনকেন্দ্রীক চলচ্চিত্র ‘মনের মানুষ’। লালনের বিশ্বাসের জায়গায় মানুষের ভেতরের মনের মানুষের কোনো ধর্ম, বর্ণ জাত–পাত নেই। মানুষের শরীর দৃশ্যমান এবং ভেতরের মনের মানুষ অদৃশ্য। তাঁর মতে মানুষের দৃশ্যমান শরীরে যে মনের মানুষের বাস, সেই মানুষের মনেই ঈশ্বর থাকেন। লালনের গানের এই দর্শনকে কোনো বিশেষ ধর্মের ধর্মীয় আদর্শের গণ্ডির সীমারেখায় আবদ্ধ করা চলে না। রবীন্দ্র সংগীত ও নজরুল সংগীত এর মত লালনগীতিও আমাদের সংগীতাকাশে একটি উজ্জ্বল তারকা হয়ে জ্বলছে বহুকাল ধরে। সেই সংগীতের মায়াজালে অবগাহন করেছেন বহু লালন গানের ভক্ত অনুরাগী। গান হচ্ছে একটি গুরুমুখী বিদ্যা। গানের কথার মধ্যে শিল্পীকে প্রবেশ করেই গান গাইতে হয়। এটি একটি নিরন্তর সাধনার বিষয়। সে জন্য কোনো গান– কোনো কোনো শিল্পীর কণ্ঠেই যেন সঠিক গায়কীতে প্রস্ফুটিত হয়। সেজন্য শিল্পীদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ ঘরানার শিল্পী হয়ে ওঠেন এবং সেই গানের শিল্পী হিসাবেই আমরা তাঁকে চিনি। ফরিদা পারভীনকে তেমনই আমরা লালন গীতির শিল্পী হিসাবেই জানি। লালনগীতির যে ভাবধারা ও দর্শন যেন ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে বিমূর্ত হয়ে ধরা দেয়। লালনগীতির যে বিশ্বজনীনতা তাঁর অবদানও ফরিদা পারভীনের। ফরিদা পারভীনের জন্ম যেন লালনগীতির জন্যই। এমন দরদী কণ্ঠে লালনগীতি পরিবেশনার শিল্পী দ্বিতীয়জন আর নেই। গান পরিবেশনার সময় গানের বাণীতে প্রবেশ করে তিনি যেমন চলে যান ভিন্ন একটি জগতে, তেমনি দর্শক শ্রোতাদেরও নিয়ে যান আধ্যাত্মিকতা ও মানব ধর্মের ভিন্ন এক আবেগের জগতে। এখানেই ফরিদা পারভীনের গায়কী সার্থকতা। তাই লালন আর ফরিদা পারভীন বাঙালিদের কাছে ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছেন একে অপরের পরিপূরক। ফরিদা পারভীনের সংগীত চর্চা কিন্তু লালনগীতি দিয়ে শুরু হয়নি। তাঁর সংগীত চর্চা শুরু হয়েছিলো নজরুল সংগীত চর্চার মধ্য দিয়ে। কিন্তু কীভাবে ধীরে ধীরে তিনি লালনের গানের বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে লালনগীতিতে মনোনিবেশ করেন তা তাঁর এক সাক্ষাৎকারে আমরা জানতে পারি। তিনি ঐ সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আসলে লালনগীতির একটা আধ্যাত্মিক টান আছে। সেই টানে আমি এই ধারায় চলে এসেছি। তখন কুষ্টিয়ায় থাকতাম। মুক্তিযুদ্ধের পর অর্থাৎ ’৭৩ সালের দিকের কথা। লালনের আখড়ায় প্রতিবছর উৎসব হতো। আমার বাবা উপদেশ দিলেন দু–একটি লালনগীতি শিখে রাখতে। উৎসবে গাওয়ার জন্য। আমি তাঁর কথায় প্রথমে আমল দিইনি। পরে একটা গান শিখলাম ‘সত্য বল, সুপথে চল’। তিন দিনব্যাপী লালন উৎসবের একদিন আমি ওই গানটা গাইলাম। দেখলাম ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি দর্শকদের কাছ থেকে। সবার অনুরোধ আরও গাইবার জন্য। এ ঘটনার পর আমার মনে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হলো। সিদ্ধান্ত নিলাম, লালনগীতিই আমি গাইব। তাই করলাম। তখন থেকেই লালনগীতি আমার আত্মার মাঝে মিশে গেছে।’ সত্যিকার অর্থে সেই থেকে ফরিদা পারভীন হয়েছেন আমাদের লালন কন্যা। বিভিন্ন ঘরানার শিল্পীদের মধ্যে আমরা অনেক শিল্পীকে দেখতে পাই বা এক্ষেত্রে অনেকেরই নাম আসে। কিন্তু লালনগীতির ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীন এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর মৃত্যু সংগীত জগতের অপূরণীয় ক্ষতি। আরেকজন ফরিদা পারভীন আসবেন কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে। সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন, সময় গেলে সাধন হবে না, বাড়ির কাছে আরশিনগর, শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে দেখতে যেমন ভুজঙ্গনা, মিলন হবে কত দিনে, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়, জাত গেলো জাত গেলো বলে, আমি অপার হয়ে বসে আছি, কে বোঝে সাঁইয়ের লীলাখেলা, আপন ঘরের খবর লে না,- লালনের এমন মানবতাবাদী গানগুলো যেন ফরিদা পারভীনের কণ্ঠের জাদুতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। সামপ্রতিক সময়ে সামপ্রদায়িক নানা বিষবাষ্পে সমাজ যখন ক্ষত–বিক্ষত সেখানে লালনের গান যেন বারবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। লালন শুধু প্রবীণদের কাছেই নন, নতুন প্রজন্মের কাছেও অনুসন্ধিৎসুর এক বিশাল চারণভূমি। ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে সরাসরি লালনগীতি শোনার একটি সুখকর অনুভূতি এখনও মনকে স্মৃতিময় করে তোলে। ২০২৩ সালে ঢাকার বইমেলায় অধ্যাপক খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার অনুষ্ঠানে সে সুযোগটা হয়েছিলো। ঐ অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম থেকে গিয়ে শিশুসাহিত্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আগের দিন সন্ধ্যায় আমি, কবি ও ব্যাংকার জসিমউদ্দিন খান আর ছড়াকার ও লেখক গৌতম কানুনগো দাদা একুশের মূল মঞ্চে তাঁর সরাসরি লালনগীতি পরিবেশনা উপভোগ করেছিলাম। অসাধারণ ছিল সেই পরিবেশনা। কে জানতো তার মাত্র বছর দুয়েক পরেই তিনি না ফেরার দেশে চলে যাবেন। লালন আমাদের মানবতার যে দর্শন দিয়ে গেছেন তা ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে দেশ–কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে গেছে বিশ্বজনীন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, কলেজ শিক্ষক।











