ফরমালিন হচ্ছে ফার্মালডিহাইড গ্যাসের পানিতে মিশ্রিত দ্রবণ যেখানে সাধারণত ৩৭ থেকে ৪০% ফার্মালডিহাইড গ্যাস থাকে। এটি একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক যার স্বল্পমেয়াদী থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি বিষক্রিয়া মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে। বর্তমান বিশ্বে ফরমালিন মিশ্রিত খাদ্য বিষক্রিয়া জনজীবনে এক মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বহু দেশে খাদ্য ভেজাল একটি দৃশ্যমান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। ফরমালিন মূলত রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পানিতে মিশ্রিত একটি শক্তিশালী জীবানু নাশক রাসায়নিক দ্রব্য যা শিল্পকারখানা, ল্যাবরেটরি, চিকিৎসা বিজ্ঞান মতে হাসপাতালে মরদেহ সংরক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয়। ভয়াবহ সমস্যা হলো খাদ্য সংরক্ষণের অজুহাতে কিংবা অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যে অতিরিক্ত ফরমালিন মিশিয়ে থাকে যা মানবদেহে এমনকি প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষায় মারাত্মক বিপর্যয় ঘটায়। নির্বিচারে ফরমালিনের ব্যবহার মানবদেহে ভয়ানক বিষ ক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফরমালিন মানব দেহে প্রবেশ করলে তা লিভার, কিডনি, শ্বাসযন্ত্র ও রক্ত সঞ্চালনে ভীষণ ব্যাঘাত সৃষ্টিসহ দীর্ঘ মেয়াদে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। বিষক্রিয়া এবং অপব্যবহারের কারণে ফরমালিন মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক পদার্থ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ১০ জুন ২০১১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল টক্সিকোলজি প্রোগ্রাম কর্তৃক ফরমালিন মানুষের ক্যান্সার রোগ সৃষ্টিতে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে জানায়। ফরমালিন বিষক্রিয়া রোধের বিষয়টি শুধু স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় নয় বরং এটি একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত বলে এর প্রতিরোধ এখন সময়ের দাবী।
খাদ্য সংরক্ষণে ফরমালিনের ব্যবহার মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে উঠে। ফরমালিনযুক্ত খাবার নিয়মিত খেলে মানবদেহে নানান রোগ দেখা দেয় যা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ফরমালিনের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার ফলে এটি মানবদেহে প্রবেশ মাত্র কোষের গঠন নষ্ট করে দেয় যারফলে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘ মেয়াদি নানান উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
১) তাৎক্ষণিক বিষক্রিয়ার ফলে চোখ ও নাকে তীব্র জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি হতে পারে। গলা শুকিয়ে শ্বাসকষ্ট ও কাশির প্রকোপ ঘটার সম্ভাবনা থাকতে পারে।
২)পাকস্থলী ও পরিপাক যন্ত্রের জ্বালাপোড়া।
২) লিভার ও কিডনির ক্ষতিসাধন
৩) শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা ও বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে। পেটব্যথা ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবণা দেখা দিতে পারে।
৪) দীর্ঘ মেয়াদে ক্যানসারের ঝুঁকি
৫) শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি প্রাপ্তি ব্যাহত হওয়া ও রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ।
৬) ফরমালিন ত্বকে লাগলে জ্বালাপোড়া অনুভব হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদি প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিভার, কিডনি কোষ নষ্ট হয়ে কার্যক্ষমতা হারাতে পারে। শ্বাসতন্ত্রে স্থায়ী ক্ষতির কারণে ব্রঙ্কাইটিস ও হাঁপানি দেখা দিতে পারে। রক্তকণিকা ক্ষতি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এই সমস্ত ক্ষতির কারণে ফরমালিন শুধু খাদ্য ভেজালের একটি ক্ষতিকর উপাদান নয় বরং ধীরে ধীরে সমাজের সুস্থ জীবনধারার জন্য মারাত্মক এক হুমকিস্বরূপ। ফরমালিন এ রাসায়নিক দ্রব্যটি ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে। অনেক ওষুধ ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে, তবে সাথে সাথেই পরিপাকতন্ত্রের মাধ্যমে শেষপর্যন্ত বজ্য আকারে বেরিয়ে যায়। অপরপক্ষে ফরমালিন শরীরে থেকে যায়। খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের পর বিপাক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট বজ্য কিডনির মাধ্যমে বের করে দেওয়ার কাজ করে মানুষের লিভার। কিন্তু ফরমালিনে আক্রান্ত কোষগুলোকে বের করে দিতে পারে না। ফরমালিনের কারণে লিভার থেকে বের হওয়া এনজাইমগুলো নষ্ট হয় যা লিভার ও কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। পরিনতিতে লিভার সিরোসিস হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে ফরমালিন মিশ্রিত শাকসবজি, ফলমূল, মাছ মাংস খেলে লিভার ক্যান্সার, হার্টের অসুখ ও কিডনি নষ্ট হতে পারে। ফরমালিন মিশ্রণ যেহেতু একটি দণ্ডনীয় অপরাধ এবং ফরমালিনের বিষক্রিয়া একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে বিরাজমান সেহেতু সচেতন জনগণ, সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহ এবং সরকারকে ফরমালিনের অপব্যবহার জনিত ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ফরমালিন মিশ্রিত খাবার এড়াতে হলে বিষক্রিয়া প্রতিরোধে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১) ফলমূল, শাকসবজি, মাছ মাংস কেনার আগে ঘ্রাণ নিয়ে দেখা উচিত। অস্বাভাবিক তীব্র গন্ধ হলে ধরে নিতে হবে এসব দ্রব্য ফরমালিন যুক্ত।
২) সম্ভব হলে সবক্ষেত্রে যাচাই বাছাই করে ফরমালিন মুক্ত তাজা পণ্য ক্রয় করা উচিত।
৩) ফলমূল, শাকসবজি এবং সব ধরনের মাছ ১৫/২০ মিনিট পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ফার্মালডিহাইডের ঘনত্ব কমে আসে যারফলে খাদ্যে বিষক্রিয়ার মাত্রাও কমে আসবে।
৪) খাবার সংরক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক উপায়, যেমন বরফ বা ফ্রিজের তাপমাত্রা প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে হবে।
৫) লেবুর রস, লবণ বা ভিনেগার ব্যবহার খাবারকে স্বাভাবিকভাবে সংরক্ষণে সাহায্য করে। লেবুর সাইট্রিক এসিড এবং ভিনেগারের এসিটিক এসিড ফরমালিনের রাসায়নিক ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য দুর্বল করে দেয়। কাঁচা ফলমূল, শাকসবজী ধোয়ার সময় কয়েক ফোটা লেবুর রস বা ভিনেগার মিশালে ফরমালিন বিষক্রিয়ার প্রভাব কিছুটা কমে যাবে। বাজার থেকে ক্রয়কৃত সবজি, ফলমূল, মাছ মাংস শক্ত চকচকে সন্দেহজনক মনে হলে তা পরিহার করতে হবে।
৬) সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় স্বাস্থ্য খাতে যথোপযুক্ত উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
৭) চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে জনগণকে ফরমালিনের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতন করতে হবে।
৮) এক্ষেত্রে ফরমালিনের বিষক্রিয়া দেখা দিলে অনতিবিলম্বে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া প্রয়োজন।
অনুমোদিত দোকান থেকে খাদ্য শস্য কিনলে ফরমালিন মুক্ত দ্রব্যাদি পাওয়া যাবে। বাজারের প্রবেশপথে ফরমালিন ডিটেকশন কিট ব্যবহার একটি কার্যকর ব্যবস্থা। সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন শহরে এসব যন্ত্র ব্যবহার শুরু করেছে। তবে প্রতিটি বাজারে তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ফরমালিন নিয়ন্ত্রণে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে তা আরো শক্তিশালী ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে উদ্যোগী হতে হবে। ২০১৫ সালের ফরমালিন নিয়ন্ত্রণে আইন অনুসারে খাদ্যে ফরমালিন ব্যবহার অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে। তবে সুসংহতভাবে আইনের প্রয়োগ ও ধারাবাহিক নজরদারির সবিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। যদিও বিভিন্ন শহরে ” ফরমালিন মুক্ত কর্ণার ” চালু আছে, এ উদ্যোগ সারাদেশে সম্প্রসারিত করার প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিটি শহরে ফরমালিন শনাক্তকরণ ল্যাব স্থাপন করা হলে বাজার তদারকি ফলপ্রসূ ও নির্ভুল হবে। টিভি, রেডিও, পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফরমালিনের ক্ষতিকর দিক নিয়ে নিয়মিত প্রচার প্রচারণার প্রয়োজন। স্কুল কলেজের পাঠ্যবইয়ে নিরাপদ খাদ্য এবং ফরমালিনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে পাঠ্য অধ্যায় যুক্ত করা যেতে পারে। বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে, বেসরকারি সংগঠন গ্রাম শহরে ক্যাম্পেইন, সেমিনার, পোস্টার প্রচারণা – ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের মাঝে ফরমালিনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ফরমালিন প্রতিরোধে জনগণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ জনগণের সচেতনতা ছাড়া সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। ফরমালিনের বিষক্রিয়া এড়াতে হলে ক্রেতাদের খাদ্য কেনার সময় সতর্ক থাকতে হবে। যাচাই–বাছাই করে পণ্য ক্রয় এবং সন্দেহজনক হলে বর্জন করতে হবে। পরিবারে শিশুদের ছোটবেলা থেকে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। মসজিদ, মন্দির, কমিউনিটি সেন্টার ও হাটবাজারে জনগণকে ফরমালিনের বিষক্রিয়া এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে।
ফরমালিন বিষক্রিয়া রোধ একটি বহুমাত্রিক কাজ। এখানে সরকারের কঠোর তদারকি, বেসরকারি সংস্থার দায়িত্বশীলতা এবং জনগণের ব্যক্তিগত সচেতনতা – এই তিনটি শক্তিকে একযোগে কাজ করতে হবে। ফরমালিনের অপব্যবহার শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, এটি মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস, অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। তাই খাদ্যে ক্ষতিকর ফরমালিনের ব্যবহারের বিরুদ্ধে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। ফরমালিন মুক্ত খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা শুধু স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজন নয়, এটি হওয়া উচিত একটি মানবিক দায়িত্ব ও সামাজিক অঙ্গীকার। এক্ষেত্রে উৎপাদনকারী, বিক্রেতা, ভোক্তার সম্মিলিত সচেতনতা এবং সরকারের কঠোর নজরদারি অপরিহার্য। নিরাপদ খাদ্য চাহিদা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর এই অধিকার নিশ্চিত করা সরকার, সচেতন জনগণ সহ আমাদের সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব। সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ফরমালিন মুক্ত সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। তাই আমাদের শপথ হোক –খাদ্যে ভেজাল নয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা হোক প্রধান লক্ষ্য।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, প্রাক্তন অধ্যক্ষ রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ ও বর্তমানে রেক্টর, বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ, মিরপুর, ঢাকা।












