ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীতে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত, সাড়ে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী

নাজিরহাটে ভেঙেছে হালদার বাঁধ, সর্তা খালে ২টি ও ধুরুং খালের ২টি স্থানে বাঁধ ভেঙে ঢুকছে পানি । ফরহাদাবাদে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে যুবকের মৃত্যু

আজাদী ডেস্ক | শনিবার , ২৪ আগস্ট, ২০২৪ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী উপজেলা। দুই উপজেলায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। ফটিকছড়িতে হালদা নদী, ধুরুং ও সর্তাখালের ৩০ স্থানে পানি ঢুকে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় শতাধিক গ্রামের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। এসব এলাকায় নষ্ট হয়ে গেছে সব ফসলি জমি।

হালদা নদীর পানি ফটিকছড়িতে বিপদসীমার সর্বোচ্চ ১১০ সে.মি.-এর উপরে প্রবাহিত হয়েছে। এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে হালদা নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে উপজেলার আওতাধীন ১৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার প্রায় দুই লক্ষাধিক লোক পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১নং ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের ৬ টি ওয়ার্ডে বসবাসকারী লোকজন। এই ইউনিয়নে পানি ঢুকে গেলে ঘরের আইপিএস খুলতে গিয়ে মো. জিয়াউর রহমান সাকিব (২২) নামে এক যুবক বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে। সে ওই এলাকার মো. জসিম উদ্দিনের পুত্র। বন্যা দুর্গত এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। ফলে খবর মিলছে না বিপদে পড়া অনেক মানুষের। কলা গাছ ও বাঁশের ভেলায় পানিতে ভাসছে মানুষ, গবাদি পশু, হাঁসমুরগি।

আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর : ফটিকছড়ি প্রতিনিধি মোহাম্মদ জিপন উদ্দিন জানান, ফটিকছড়িতে বন্যা কবলিত এলাকায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। হালদা নদী, ধুরুং খাল ও সর্তা খালের প্রায় ৩০টি স্থানে বাঁধ ভেঙে শত শত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের এক তলা ভবনের ছাদেও উঠে গেছে পানি। পানিতে ভেসে গেছে মাছের ঘের, ফসলি জমি। তুলনামূলক উঁচু রাস্তাগুলোও ডুবে যাওয়ায় আশ্রয়ের জায়গা পাচ্ছে না মানুষ।

উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ অফিস সূত্র জানিয়েছে, পানিবন্দী ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ফটিকছড়িতে ৫০ মেট্রিক টন চাল এবং শুকনো খাবারের জন্য সরকারিভাবে ৪লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সংস্থাও ত্রাণ দিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত সকল এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পিআইও আবুল হোসেন জানান, কিছু জায়গায় ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হলেও বেশকিছু স্থানে যাওয়া যাচ্ছে না। বোট দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ৩টি স্থানে হালদার বাঁধ ভেঙে গেছে এবং ১৯টি স্থানে বাঁধ বা পাড়ের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়াও সর্তা খালে ২টি এবং ধুরুং খালের ২টি স্থানে বাঁধ ভেঙে বেশকিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীর প্রকৌশলী মোহাম্মদ সোহাগ তালুকদার বলেন, গত ৫০ বছরে হালদা নদীর পানি ফটিকছড়িতে বিপদসীমার সর্বোচ্চ ১১০সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। স্মরণকালের ২য় সর্বোচ্চ বন্যার কবলে ফটিকছড়ি। নদনদীর পানিতে শতাধিক গ্রাম এবং প্রায় দেড় লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তর ফটিকছড়ির বাগানবাজার, দাঁতমারা, নারায়ণহাট এবং ভূজপুরে বন্যায় মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়লেও ধীরে ধীরে এসব এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। ফলে বন্যার উন্নতি হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মোজাম্মেল হক।

এদিকে নাজিরহাট পৌরসভা, সুয়াবিল, হারুয়ালছড়িতে হালদার পানি উপচে লোকালয়ে ঢুকছে পানি। ইতিমধ্যে আশপাশের এলাকা ডুবে গেছে। একইসাথে ফটিকছড়ি নাজিরহাট এলাকায় চট্টগ্রামখাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়কের দুইটি স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ১০ ফুট রাস্তা ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে। সড়কের নিচ থেকে সরে যাচ্ছে ইট, বালি কংক্রিট। সড়কটি ভেঙে গেলে খাগড়াছড়ি, ফটিকছড়ি চট্টগ্রাম থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ঁবে। সরেজমিনে সুয়াবিল, নাজিরহাট পৌরসভায় গিয়ে দেখা যায়, নাজিরহাট পৌরসভার রশিদা পুকুর পাড়, পূর্ব সুয়াবিল, পশ্চিম সুয়াবিল, দীঘির পাড়, ভাঙ্গা দীঘির পাড় এলাকায় কোমরসমান কোথাও বা হাঁটুসমান পানি জমেছে। অনেক স্থানে বাড়ির নিচ তলা ডুবে গেছে। যাদের মাটির বা বেড়ার ঘর তারা কেউ রাস্তায় কেউ বা উঁচু জায়গায় অবস্থান নিয়েছে। অনেকে মানুষের ছাদে অবস্থান নিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছে। সুয়াবিল বন্যাদুর্গত এলাকার বাসিন্দা হোসেন আলী বলেন, আমার ঘর যা ছিল হালদায় ডুবেছে। গতকাল থেকে কিছু না খেয়ে আছি। কোথাও জায়গা না পেয়ে শেষে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছি। একইচিত্র হারুয়ালছড়ি এবং সুয়াবিল ইউনিয়নের। এ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী দলের সদস্য মো. সাইফুল বলেন, সুয়াবিল এলাকার ভিতরে কোথাও মাথা সমান পানি। আমরা নৌকা নিয়ে তাদের সামান্য সহায়তা করেছি। এসব মানুষের পাশে সবারই দাঁড়ানো উচিত। যদি বৃষ্টি হয় বা পানি বাড়ে এসব এলাকার মানুষের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে।

ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ফটিকছড়ি ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। উত্তর ফটিকছড়িতে পানি কমেছে। কিছু এলাকায় এখনো অস্বাভাবিক বন্যা। তবে পুরো রাত স্বেচ্ছাসেবকরা ফটিকছড়িতে এসে ত্রাণ সহায়তাসহ বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার করছেন এটা সত্যিকারের মানবিকতা। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সহযোগিতা থাকবে তা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে। পর্যাপ্ত আশ্রয়ণকেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে।

হাটহাজারী প্রতিনিধি কেশব কুমার বড়ুয়া জানান, হাটহাজারীতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে তেমন বর্ষণ ছিল না। তাছাড়া গতকাল শুক্রবার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ও বৃষ্টি ছিল না। কিন্তু হালদা নদী, অন্যান্য শাখা খাল ও ছড়ায় পাহাড়ি ঢলের প্রকোপ থাকায় উপজেলার আওতাধীন বিভিন্ন ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত ছিল। এতে করে উপজেলার আওতাধীন ১৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার প্রায় দুই লক্ষাধিক লোক পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১নং ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের ৬টি ওয়ার্ডে বসবাসকারী লোকজন। বৃহস্পতিবার রাতে নাজিরহাট নতুন ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় হালদা নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। এতে ৪ নং ওয়ার্ডের ছালে আহাম্মদ দফাদারের বাড়ি এলাকার হালদা নদীর বেড়ি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এই ইউনিয়নে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। বেড়ি বাঁধ ভেঙে বাঁধ সংলগ্ন ছালে আহাম্মদ দফাদারের বাড়ির মো. মোরশেদ ও মো. দিদারুল আলমের দুই পরিবারে বসত ঘর ও ঘরে রক্ষিত যাবতীয় মালামাল ঢেলের পানিতে ভেসে গেছে। হালদা নদীর বেড়ি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ইউনিয়নের ৩ হাজার পরিবারের বসত ঘরে পানি ঢুকেছে। হালদা নদীর বেড়ি বাঁধ ভেঙে ইউনিয়নের প্রায় ত্রিশ হাজার লোকজন সীমাহীন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ভোর থেকে এই ইউনিয়নে বিভিন্ন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা বন্যা দুর্গতদের নৌকা সাম্পান ও স্পিড বোট নিয়ে আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধার করছেন। তাছাড়া ত্রাণ, শুকনা খাবার ও সুপেয় পানীয় বিতরণ করছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে গতকাল দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। অনেক মানুষকে কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের আশ্রয় কেন্দ্র, নাজিরহাট কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয়, নাজিরহাট কলেজ ও স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় কেন্দ্রে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আনা হয়েছে। নাজিরহাট এলাকার আশেপাশে যেসব পরিবারের বহুতল ভবন রয়েছে সেখানেও আশ্রয় দেওয়া হয়েছে অনেক বন্যা দুর্গত পরিবারকে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে খিচুড়ি বিতরণ করা হয়েছে। হালদা ভাঙনের কারণে ইউনিয়নের অন্তত ২৫টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত এলাকার অনেকের বসত ঘরে কোমর পানি দেখা গেছে সরেজমিন পরিদর্শনের সময়। ইউনিয়নের গৃহস্থ পরিবারে গবাদি পশুগুলো মহাসড়কের উপর নিরাপদ আশ্রয়ে রাখতে দেখা গেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে হালদা নদীর বেড়ি বাঁধ ভেঙে বাড়িঘরে পানি ঢুকে গেলে ফরহাদাবাদে ঘরের আই পি এস খুলতে গিয়ে মো. জিয়াউর রহমান সাকিব (২২) নামে এক যুবক বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেছে। সে এই এলাকার মো. জসিম উদ্দিনের পুত্র।

উপজেলা মৎস্য বিভাগ এবং হালদা গবেষক অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, বন্যার পানি চলে গেলে বুঝা যাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং কি পরিমাণ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।

১ নং ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত আলম শওকত জানান, ইউনিয়নের ৪, , , , ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের প্রায় তিন হাজার পরিবারের বসত ঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়ে। এতে প্রায় ২৫ হাজার লোক সীমাহীন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া প্রায় ২৫ টি পুকুরের মাছ ভেসে যায়। হালদার পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করলে তিনি এলাকাবাসীকে সর্তক থাকতে আহ্বান জানান বলে উল্লেখ করেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম মশিউজ্জামান জানান, উপজেলার আওতাধীন প্রত্যেক ইউনিয়নে অতি বৃষ্টির কারণে বন্যা দেখা দিয়েছে। তবে হালদা নদীর নাজিরহাট নতুন ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় বেড়ি বাঁধ ভেঙে গিয়ে ১ নং ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডের বসত ঘরে ঢলের পানি ঢুকে পড়েছে। দুর্গত পরিবারের প্রায় ৫ হাজার লোককে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে খিঁচুড়ি বিতরণ করা হয়েছে। দক্ষিণ হাটহাজারীর শ্যামা সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয় ২০/২৫ টি পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ফরহাদাবাদ ইউনিয়নে এক যুবক বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপানি ছাড়ার আগে যেন সতর্ক করা হয়, ভারতকে সেটা জানানো হবে : পানি সম্পদ উপদেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধচকরিয়া-পেকুয়ার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি