পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে অতিরিক্ত পরিমাণে প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের বঙ্গোপসাগর প্লাস্টিক দূষিত সমুদ্রের মধ্যে নবম স্থানে আছে। প্লাস্টিক শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয় বরং এটি অর্থনৈতিক সমস্যাও বটে। প্রথমে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্লাস্টিকমুক্ত করার প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে প্লাস্টিকের ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে তারা ক্ষতিকর প্লাস্টিক ব্যবহার বাদ দিয়ে দেশকে স্থানীয় ও টেকসই প্লাস্টিকমুক্ত সমাধানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এর পুরকৌশল বিভাগ ও এসসিআইপি প্লাস্টিকস প্রকল্পের উদ্যোগে নগরীর রেডিসন ব্লু হোটেলে আয়োজিত ‘প্লাস্টিকমুক্ত টেকসই সামুদ্রিক পরিবেশ’ শীর্ষক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের সমাপনী অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের জুট মিলগুলোর প্রায় বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে আছে, আমরা যদি প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করি তাহলে আমাদের জুট মিলগুলো আবার চালু হওয়ার সুযোগ পাবে। এভাবে পরিবেশের পাশাপাশি আমরা অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হব।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, খাদ্যপণ্যের প্লাস্টিক কনটেনার বা বোতল ও মোড়ক তৈরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক ‘বিসফেনল এ’ বা বিপিএ খাবারের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে সব বয়সী মানুষের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ ঘটাচ্ছে বলে সতর্ক করেছে ইউরোপীয় খাদ্য সংস্থা–ইএফএ। ইএফএ নিউজ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে ইউরোপিয়ান ফুড সেফটি অ্যাসোসিয়েশনের (ইএফএসএ) বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপিএ মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ইউরোপীয় কমিশন এবং ইউরোপীয় দেশগুলো এখন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার পথ খুঁজবে। বিপিএ হল একটি রাসায়নিক পদার্থ, যা অন্যান্য পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে প্লাস্টিক ও রেজিন তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। যেমন– পলিকার্বোনেটে বিপিএ পাওয়া যায়। এই পলিকার্বোনেট হল এক ধরনের স্বচ্ছ অনমনীয় প্লাস্টিক, যা বারবার ব্যবহারযোগ্য পানির বোতল, অন্যান্য পানীয় ও খাবারের পাত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া খাদ্যপণ্যের পাত্র বা কনটেনারের ভেতরের আবরণে ব্যবহৃত ইপোক্সি তৈরিতেও এর ব্যবহার হয়। বিপিএ এর মত রাসায়নিকগুলো কন্টেইনারে থাকা খাবার ও পানীয়তে সামান্য পরিমাণে মিশে যেতে পারে। ফলে সেগুলো কোন মাত্রা পর্যন্ত নিরাপদ, তা বুঝতে পর্যায়ক্রমে নতুন নতুন তথ্যের আলোকে পর্যালোচনা করেন ইএফএসএ এর বিজ্ঞানীরা।
প্লাস্টিক দূষণ অত্যন্ত মারাত্মক। কেননা প্লাস্টিক মাটির সাথে সহজে মিশে যায় না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক ব্যবহার করে তা যেখানে সেখানে ফেলছি। ফলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। ঘর কিংবা বাইরে চোখে প্রথমেই যা দেখি তাহলো প্লাস্টিক আর প্লাস্টিক। এ যেন প্লাস্টিকের সঙ্গেই আমাদের বসবাস। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্ষতি এবং আশঙ্কার কারণ এই প্লাস্টিক। জীবনযাত্রা সহজ করা এই প্লাস্টিক পণ্য এখন আমাদের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
জানা যায়, ১ কোটি টন প্লাস্টিক প্রতিবছর বিশ্বসমুদ্রে জমা হচ্ছে। পৃথিবীতে উৎপাদিত ১৯ কোটি টন প্লাস্টিক আবর্জনার একটি ভাসমান দ্বীপ গড়ে উঠেছে, যা বাংলাদেশের প্রায় ১১ গুণ বড়। ১০ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী প্রতিবছর প্লাস্টিক দূষণে মারা যায়। মানুষ জীবদ্দশায় গড়ে ১৮ কেজির বেশি প্লাস্টিক খাদ্যের সাথে গ্রহণ করে। ২০৫০ সালে বিশ্বসমুদ্রে প্লাস্টিকের সংখ্যা হবে মাছের থেকেও বেশি। এই ভয়াবহ খবরটি জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম জার্নাল। সংস্থাটি বলছে, গত ৫০ বছরে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেড়েছে, যা আগামী ২০ বছরে এর পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে। প্রত্যেক বছর প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। সংস্থাটি আরো জানায়, প্রতি মিনিটে মানুষ যত পরিমাণ প্লাস্টিক জমা করছে, তা একটা গারবেজ ট্রাকের সমান।
তাই প্লাস্টিক দূষণ এড়াতে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে প্লাস্টিকজাত বোতল যেখানে সেখানে যেন ফেলতে না পারে তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কঠোর আইন প্রয়োগই পারে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে। যেভাবেই হোক প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে।








