প্লাস্টিক ও জলাবদ্ধতা

আয়েশা পারভীন চৌধুরী | রবিবার , ৩ আগস্ট, ২০২৫ at ৮:৫২ পূর্বাহ্ণ

বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই মানুষকে জলাবদ্ধতার কারণে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ভারী বর্ষণের ফলে বন্যা পরবর্তীতে পানি নামতে পারে না। পানি নামতে অনেক সময় লাগে। তাই সাধারণ জনগণ বর্ষায় জলাবদ্ধতার আতঙ্কে সময় গুণতে থাকে। উপকূলীয় অঞ্চলগুলো বর্ষা মৌসুমে যেভাবে প্লাবিত হয় তার চেয়ে পরবর্তীতে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বর্ষায় জলাবদ্ধতা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ের মতো বিবেচিত হয়। এই জলাবদ্ধতা বেশ কিছু বছর থেকে অনেক বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নগরায়নের ফলে পানি নিষ্কাশনের পাশাপাশি বিভিন্ন প্লাস্টিক দ্রব্যের অপব্যবহারের ফলে জলাবদ্ধতা একটা বিশাল বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই বড় বড় শহরগুলো পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। আর এ পানি সরতে অনেক সময় লাগে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় অফিসগামী মানুষ ও খেটে খাওয়া মানুষগুলোর নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে নিয়ে স্কুলে আসা যাওয়াটা একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে পড়ে। স্রোতের বিপরীতে গাড়ি চালিয়ে অথবা পা হেঁটে যাওয়াটা নিরাপদ নয়। মাঝে মাঝে এমন এমন ঘটনা ঘটে যা কী না কখনো কাম্য নয়। জলাবদ্ধতার কারণে পায়ে হেঁটে চলায় অনেক মানুষ শারীরিকভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাছাড়া বড় বড় ড্রেনগুলো পানিতে ভর্তি হওয়ায় ফুটপাত ও ড্রেনগুলো প্রায় একই রকম লাগে। বিবেকবর্জিত কিছু মানুষ লোভ লালসার বশবর্তি হয়ে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করে। ফলে ফুটপাতগুলো অরক্ষিত হয়ে থাকে। জলাবদ্ধতার সময় ম্যানহোলে পড়ে অনেকে অকালে মৃত্যুবরণ করে। অনেক সুস্থ সবল মানুষও ড্রেনের পানিতে ভেসে যায়। অতি সম্প্রতি বর্ষার শুরুতে একটি বাচ্চা হঠাৎ পানিতে তলিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। প্রতি বছর এধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে থাকে। চোখের সামনে টুপ করে ডুবে যাওয়া মানুষটি একেবারে নিখোঁজ হয়ে যায়। অনেক খোঁজখুঁজির পরে মৃত নিথর দেহখানি পাওয়া যায়। বছরের শুরুতে বিভিন্ন ড্রেনের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে গিয়ে শুধু প্লাস্টিক আর প্লাস্টিক পাওয়া যায়। প্লাস্টিক অপচনশীল হওয়াতে জলবদ্ধতা মারাত্মক আকার ধারণ করে।

ভালো কাজ সব সময় প্রশংসনীয়। মন্দ কাজ সব সময় সমালোচিত। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে এর প্রমাণ করে আসছে। বিশেষ করে যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক ভূমিকা প্রশংসনীয় হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবাদী সংগঠন প্লাস্টিকের বিনিময়ে বই বিনিময়ের আয়োজনে করেছে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের পুরনো পঠিত অপ্রয়োজনীয় বই দিয়ে প্লাস্টিক সংগ্রহ করে। ১৩ নভেম্বর ২০২৪ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জিরো পয়েন্টে বই বিনিময় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে দিচ্ছেন বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ও পরিবেশ সুরক্ষা সচেতনতা বার্তা। এছাড়া প্লাস্টিকের বিনিময় বই উৎসব করে বইয়ের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে। বই বিনিময়ের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য কিছু করতে পেরে শিক্ষার্থীদের অনেক অনেক ভালো লেগেছে। বই বিনিময়ের পাশাপাশি পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ক এমন একটি উদ্যোগকে সবার সমর্থন করা উচিত। পরিবেশ রক্ষার এমন সুন্দর উদ্যোগকে আরো অনেক বেশি ছড়িয়ে দিতে পারলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় কমে আসবে। এধরণের উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও বেশি উৎসাহ অনুপ্রেরণা বৃদ্ধি করবে। যখন পরিবেশ রক্ষার কথা আসে তখন প্লাস্টিকের অব্যবহারে বিষয়টি সকলের নজরে আসে। তবুও বাস্তবিক অর্থে সকলের ইতিবাচক ভূমিকার বিপরীতে নেতিবাচক ভূমিকার ফলে জলাবদ্ধতার সমাধান সম্ভব হয় না।

সাম্প্রতিক বাংলাদেশের কঙবাজারে প্লাস্টিকের ভয়াবহতা জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য একটা বিশাল প্লাস্টিকের দানব তৈরী করা হয়েছে। এই প্লাস্টিক দানব তৈরির মাধ্যমে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চলে। বিশাল সমুদ্র তটে প্রতিদিন অনেক পর্যটক বেড়াতে আসে। পর্যটকরা তাদের যাবতীয় খাবার সামগ্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য আনুষাঙ্গিক জিনিসগুলো বিভিন্ন প্লাস্টিকের মাধ্যমে বহন করে। প্লাস্টিক সহজলভ্য হওয়াতে প্রতিটি জিনিসের জন্য পর্যটকরা প্লাস্টিক ব্যবহার করে যেন প্লাস্টিক নির্ভর একটি জীবনযাত্রা পরিণত হয়েছে। এই পর্যটকরা রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পাশাপাশি যে হোটেলগুলোতে থাকে ওখানেও প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যাপক ব্যবহার হয়। প্লাস্টিক খুব সহজে এবং কম খরচে কিনতে পারে বলেই সকল স্তরের মানুষ প্লাস্টিককে বেছে নেয়। এ প্লাস্টিকের মাধ্যমে পরিবেশের দিনের পর দিন বিশাল ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কারণ ব্যবহারের পর যে যার মত প্লাস্টিক যত্রতত্র ছুড়ে ফেলে। তাই সমুদ্রতট নোংরা আবর্জনায় পরিপূর্ণ হয়। প্লাস্টিক দানব তৈরির মাধ্যমে শুধুমাত্র পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়নি প্রতিটি মানুষকে সচেতন করাই হচ্ছে আসল লক্ষ্য। কারণ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কঙবাজারে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকরা বেড়াতে আসে। দূরদূরান্তের মানুষগুলো সময় ও সুযোগ পেলেই কঙবাজারে বছরে একবার দুবার বেড়াতে আসে। আর যাওয়ার সময় যা কিছু আছে তা পরিত্যক্ত হিসেবে বিভিন্নখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলে যায়। সমুদ্রতট প্রতিদিন দূষিত হচ্ছে। কক্সবাজারকে দূষণমুক্ত করার জন্য প্লাস্টিক দানব তৈরি একটি অনুকরণীয় বিষয়। প্লাস্টিক দ্বারা তৈরীর মাধ্যমে জনসম্মুখে প্লাস্টিকের দানবীয় ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা হয়েছে। মাটি দূষিত হচ্ছে। ফলে মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগ শোকে আক্রান্ত হচ্ছে। পরিবেশ ক্রমাগত ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে।

আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের রেস্তোরাঁ ও পর্যটন কেন্দ্র করে উঠেছে। এই পর্যটন কেন্দ্র ঘিরে যে জীবন ও জীবিকা গড়ে উঠে ওখানেও প্লাস্টিকের অপব্যবহার হয়। তাছাড়া প্রাত্যহিক জীবনে প্লাস্টিক যেন একটা অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। আমরা প্লাস্টিক বিহীন জীবন কল্পনায় করতে পারিনি। অতি সহজলভ্য ও অতি কম খরচে পাওয়া যায় বলে মানুষ প্রতিদিন প্রতিটি কাজে প্লাস্টিককে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। হোটেল রেস্তোরাঁ ফুটপাত দোকান পাট এমনকি ছোটখাটো ভ্যানচালকের দোকানগুলোও প্লাস্টিক নির্ভর। প্রতিটি ঘরে ঘরে প্লাস্টিক ও পলিথিন একটি অপরিহার্য সামগ্রিক হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রমাণিত হয়েছে প্লাস্টিক যে হারে ব্যবহার হচ্ছে সেভাবে বিনাশ হচ্ছে না। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ভয়াবহতা সম্পর্ক অনেক আগ থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করা জন্য সরকার উদ্যোগ নেয়। মানুষ প্লাস্টিকের পাশাপাশি পলিথিনের যথেচ্ছা ব্যবহার করে পরিবেশ দূষিত করছে। তাছাড়া বিভিন্ন বিলাস সামগ্রী ও পলিথিন এবং প্লাস্টিকে মোড়ানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ সচেতনতার অভাবে অপ্রয়োজনীয় প্লাস্টিক ও পলিথিন ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে। ফলে মাটির উপর অত্যাচার হয়। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

লেখক: প্রাবন্ধিক; কলামিস্ট; অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডা. ফজলুল হাজরা ডিগ্রী কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ