সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য (২০২৩) অনুযায়ী, দেশের উপকূলীয় নদ–নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয় কর্ণফুলী নদীতে। চট্টগ্রাম শহরের ৪০ শতাংশ প্লাস্টিকের ঠাঁই হয় কর্ণফুলীতে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, নগরে প্রতিদিন ৩ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ২৫০ টন প্লাস্টিক এবং পলিথিন বর্জ্য। এসব প্লাস্টিক বর্জ্যের ১৫০ মেট্রিক টন বর্জ্য খাল ও নর্দমায় গিয়ে পড়ে। প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে দূষিত হয় কর্ণফুলী। সাথে নদীর নাব্যতা কমায় বাড়ে জলাবদ্ধতার ঝুঁকিও। এর সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তো আছেই।
এমন পরিস্থিতিতে নগরীতে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে শুরু হচ্ছে ‘প্লাস্টিকের বিনিময়ে বাজার’ কার্যক্রম। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সহযোগিতায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এই প্রকল্প চালু করছে। এই প্রকল্পের আওতায় পতেঙ্গা ও হালিশহরে ২টি স্থায়ী স্টোর চালু থাকবে। এসব সেন্টারে যে কেউ পরিত্যক্ত প্লাস্টিক জমা দিলে পাবেন বাজার করার সুযোগ। এছাড়া ৫০টি ভ্রাম্যমাণ বাজার ক্যাম্প করা হবে। সেখানেও প্লাস্টিক জমা দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কিনতে পারবেন।
আজ সোমবার নগরের বাকলিয়া স্টেডিয়ামে প্লাস্টিকের বিনিময়ে বাজার কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। প্রথম দিন ৫ শতাধিক স্থানীয় দুস্থ পরিবার প্লাস্টিকের বিনিময়ে বাজার করতে পারবেন। প্রথম দিন ৫ মেট্রিক টন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক সংগ্রহ করার টার্গেট রয়েছে আয়োজকদের। সংগৃহীত প্লাস্টিক বাংলাদেশ পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানির মাধ্যমে রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে রিসাইক্লিং করা হবে।
জানা গেছে, প্লাস্টিক সংগ্রহে স্থাপিত সেন্টারগুলো থেকে চাল, ডাল, মাছ, মুরগি, ডিম, তেল, চিনি ও লবণসহ ২২ ধরনের নিত্যপণ্য সংগ্রহ করা যাবে প্লাস্টিকের বিনিময়ে। নেওয়া যাবে শিক্ষাসামগ্রী, কাপড়, স্যানিটারি প্যাডও। এর মধ্যে এক কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে ১ কেজি চাল, ১ কেজি লবণ, ১টি টি–শার্ট, ৬টি ডিম, ১ প্যাকেট বিস্কুট, ৪টি নুডলসের যে কোনো একটি নিতে পারবেন। একইভাবে ২ কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে ১ কেজি মসুর ডাল বা ১ কেজি ছোলা নিতে পারবেন। ৩ কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে ২ কেজি আটা, ১ কেজি চিনির যে কোনো একটি নেওয়া যাবে। ৪ কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে ১ লিটার সয়াবিন, ১টি মাছ অথবা ১টি মুরগির যে কোনো একটি নেওয়া যাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২ সালে সর্বপ্রথম প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে প্লাস্টিক এঙচেঞ্জ সেন্টার চালু করে বিদ্যানন্দ। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামেও চালু হচ্ছে এই কার্যক্রম।
বিদ্যানন্দের বোর্ড সদস্য মো. জামাল উদ্দিন আজাদীকে বলেন, প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা এতই ব্যাপক যে, এটি সরকারের একার পক্ষে রোধ করা একেবারেই অসম্ভব। এই দূষণ কমাতে দরকার ব্যাপক জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা। তাই মানুষকে সম্পৃক্ত করতে আমরা সারা দেশে প্লাস্টিক এঙচেঞ্জ স্টোর চালু করছি। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। আশা করছি এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্লাস্টিকের ভয়াবহতা সম্বন্ধে জনগণকে ধারণা দিতে পারব ও প্লাস্টিক দূষণ রোধে ও প্লাস্টিক বর্জ্য ম্যানেজমেন্টে সরকারের যে বিপুল ব্যয় তা আমাদের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে কিছুটা হলেও কমাতে সক্ষম হব।
তিনি বলেন, প্লাস্টিক এঙচেঞ্জ সেন্টার একটি টেকসই অলাভজনক বিজনেস মডেল হিসেবে ডিজাইন করেছি। প্রতি কেজি প্লাস্টিকে ৩০–৪০ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছি। যেমন প্রতি কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে গড়ে ৬০ টাকার পণ্য দিচ্ছি। সেই প্লাস্টিক রিসাইকেল কোম্পানির কাছে বিক্রি করে প্রতি কেজিতে ৩০ টাকার কম পাব। ২ লাখ কেজি প্লাস্টিক রিসাইকেল করতে আমরা পণ্য দিচ্ছি ১ কোটি ২০ লাখ টাকার। প্লাস্টিক বিক্রি করে রিসাইকেল কোম্পানি থেকে পাব ৬০ লাখ টাকা। তাহলে পরবর্তী বছর একই পরিমাণ প্লাস্টিক রিসাইকেল করতে আমাদের ভর্তুকি দিতে হবে ৫০ শতাংশের কম। এভাবে ফান্ড রিরোলিং হয়ে ৩য় বছরের পর একই পরিমাণ প্লাস্টিক রিসাইকেল করতে কোনো ভর্তুকি প্রয়োজন হবে না। প্রকল্পটি কোনো প্রকার অনুদান ছাড়াই স্বাধীনভাবে চলবে। বিদ্যানন্দ শুধু অ্যাডমিন কস্ট চালিয়ে যাবে; যেটা মিনিমাম হয় স্বেচ্ছাসেবীদের স্বেচ্ছাশ্রমের বিনিময়ে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য প্লাস্টিক দূষণ থেকে রক্ষা করা।
জানা গেছে, চারটি উৎস থেকে নগরে বাড়ছে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য। এগুলো হচ্ছে শিল্পকারখানা, কৃষি খামার, বাণিজ্যিক এবং গৃহস্থালি। নৌ–পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, সংযুক্ত খালগুলো দিয়ে নগর থেকে প্রতিদিন কর্ণফুলীতে পড়ছে গৃহস্থালির পাশাপাশি পলিথিন–প্লাস্টিকসহ অপচনশীল বর্জ্য। এসব বর্জ্যের কারণে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারানোর পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী।
বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যার ৬০ শতাংশ রাস্তাঘাট ও নদীতে যাচ্ছে। যা মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে ঢোকে এবং পরবর্তীতে তা মানুষের জীবনচক্র ও শরীরে চলে আসছে। ওই হিসেবে চট্টগ্রামবাসীও একই সমস্যায় ভুগছেন।
চুয়েটের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্লাস্টিক–পলিথিন খাবার, পান ও নিশ্বাসের সাথে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের দেহে প্রবেশ করছে। প্লাস্টিক–পলিথিনে কেমিক্যাল উপকরণ থাকে, যা ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব এবং অটিজমের মতো রোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্লাস্টিক–পলিথিন বর্জ্য পরিবেশে এসে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার (প্যাথোজেন) মতো অণুজীবকে আকর্ষণ করে, যা পরবর্তীতে প্যাথোজেন ধারণকারী মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো মানব দেহে প্রবেশ করে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। প্লাস্টিকের বিনিময়ে বাজার প্রকল্পের সাফল্য এলে এসব স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে থেকে রক্ষা পাবে নগরবাসী।