মধ্যবিত্তের কেবল বিড়ম্বনা। প্রতিনিয়ত ঝামেলা। সবসময় চ্যালেঞ্জ আর চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিন অতিক্রম করতে হয় নতুন নতুন বাধা। এই করোনা কালে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই আমরা একটা নতুন অচেনা এবং কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। উন্নয়ন গবেষক রুবাইয়াৎ সারওয়ার এক লেখায় বলেন, চিন্তিত ছিলাম মধ্যবিত্তের ওপর যে অর্থনৈতিক সংকট আসছে সেটা কে সামলাবে এই ভেবে। আমি চিন্তিত ছিলাম, কারণ আমরা দারিদ্র্যকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মধ্যবিত্তের সংকট আমরা বুঝতে পারব না ভেবে। হয়েছেও তা-ই। আমাদের কোনো গবেষণায় মধ্যবিত্ত নেই। যারা দারিদ্র্য থেকে উঠে এসেছিল কিন্তু আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে, আমরা তাদের মাথা গুনেই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি। দারিদ্র্যের হার বাড়ছে; সেখানে মধ্যবিত্ত চিহ্নিত হবে কীভাবে?
এ সংকটের ভয়াবহতাটা হলো এটা খুব শিগগির যাবে না। এখানে একজনকে ফেলে আরেকজন এগোতে পারবে না। সোশ্যাল সেইফটি নেট শুধু শ্রমিক আর অতিদরিদ্রকে কয়েক মুহূর্তের দম দেবে। তাও যদি তাদের হাতে টাকা পৌঁছায়। কিন্তু এখানে মধ্যবিত্ত কোথায়? তাঁর দায়িত্ব নেবে কে? তাকে ক্রমেই গভীর হতে থাকা অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের করে নিয়ে আসবে কে? যদি মধ্যবিত্তের ভিত্তি সরে যায়, তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতি উঠে দাঁড়াবে কীভাবে? আমাদের নগর দারিদ্র্য নিয়ে কাজ করতে হবে এখনই। সেটা করতে গেলে মধ্যবিত্তকে কিংবা তাকে কীভাবে চিহ্নিত করা হবে, সেটার ব্যাপারে একটা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত জরুরি। মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত-এ তিন শ্রেণিকে আমরা কিসের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করব, তার একটা বাস্তবিক রূপরেখা দরকার। মধ্যবিত্তকে কি আয়ের ধারায় সংজ্ঞায়িত করা হবে, নাকি ব্যয়ের ধারায়? গ্রামীণ দারিদ্র্য বুঝতে আমরা মাথাপিছু আয়, নিজস্ব জমির পরিমাণ, খাদ্যের পেছনে খরচ-এ ধরনের কিছু পরিমাপ ব্যবহার করি। এর আঙ্গিকে নগর দারিদ্র্য বুঝতে গিয়ে যদি আমরা ইনফরমাল সেক্টরে জড়িত শ্রেণিকেই বেছে নিই, তাহলে মধ্যবিত্তের সংকট চাপা পড়ে যাবে। আবার খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য পত্রিকান্তরে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের এক দশকে প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, এটা অস্বীকার করা যাবে না, যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে সংখ্যা ও গুণগত দিক থেকে একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকশিত হয়েছে। তবে করোনার ফলে বিকাশমান মধ্যবিত্তের নিম্নবিত্ত অংশটি ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এই বিকাশমান মধ্যবিত্তের সঙ্গে উচ্চবিত্তের মানুষের বৈষম্যও আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। আমরা দেখেছি, যেসব দেশে বিকাশমান মধ্যবিত্ত আয়ের ফাঁদে পড়েছে, তাদের ভেতরে সামাজিক অসন্তোষ জেগে উঠেছে। সেই অসন্তোষ ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক বিরোধিতায় ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। এর বড় কারণ হলো, যত দিন প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তত দিন সে বৈষম্য মেনে নিয়েছিল। প্রবৃদ্ধি কমে গেলে সেটি আর সে মানতে পারে না। কারণ, প্রকৃত আয় কমে গেলে তা জীবনযাত্রার ওপর আঘাত করে। মধ্যবিত্তের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সাধারণভাবে সে উপলব্ধি করে যে তার হাতে এত অর্থ নেই, যা দিয়ে সে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে যেতে পারে। সে দেশের ভেতরেই একটি গ্রহণযোগ্য ও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যব্যবস্থা চায়। অন্য দেশে সন্তানকে শিক্ষার জন্য পাঠানোর আর্থিক সংগতি তার নেই। দেশেই সে ভালো প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পড়াতে চায়। চায় পরীক্ষায় পাস করে তার সন্তান বাজারের চাহিদা অনুযায়ী চাকরি পাবে। সে দেশে একটি ভালো গণপরিবহন ব্যবস্থা চায়। সবচেয়ে বড় যেটা চায়, তা হলো নিরাপত্তা ও ব্যক্তি-সুরক্ষা। সব মিলিয়ে আয় কমে যাওয়া, সামাজিক সেবা না পাওয়া এবং ব্যক্তি-সুরক্ষার অভাব-এসবের অস্বস্তি তার ভেতরে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
করোনা চলে গেলেও এর প্রভাব থাকবে অনেক দিন। তাই কর্মসংস্থান বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় অর্থনীতির চাকায় গতি আনার জন্য বলে থাকেন। বলেছেন, সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে, ব্যক্তি খাতে প্রণোদনা দিতে হবে, তারল্য বাড়াতে হবে। কিন্তু তাঁর এসব কথার জন্য প্রয়োজন বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা। প্রয়োজন বাংলাদেশের একটি সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি।