আজ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। প্রতিবারের মতো এবারেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের বাংলাদেশেও এই দিবস নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হচ্ছে। এবারের ডায়াবেটিক সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘সবার জন্য ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও সেবা নিশ্চিতকরণ, এখন নয়তো, কখন?’
বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে বেশি দিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সব লোকেরই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটা সব সময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রতিরোধ করা যায় এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব হয়। অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে-ছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ। যাদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করেন না, গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অত্যধিক চিন্তা-ভাবনা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রোপচার, অসম খাবার, গর্ভাবস্থা এবং ওজন বেশি বেড়ে গেলে এ রোগ বাড়াতে সাহায্য করে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায়।
সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে একজন মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)-এর একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ। এদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২৬ লাখ আর ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা ৮৪ লাখ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডায়াবেটিস বিভাগের প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশে যেমন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি, তেমনি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হারও বেশি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে দশম। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে উঠে আসবে। পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে উচ্চহারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে, যেমন- বাংলাদেশ, ভারত। বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশে খুব দ্রুত নগরায়ণ, সুষম খাদ্যের গ্রহণের তারতম্যের কারণে মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুপাতিক ও কাঙ্ক্ষিত হারের চেয়ে বেশি। কায়িক পরিশ্রম দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, বিভিন্ন কারণে মানসিক চাপ বেড়েছে অনেকগুণ। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮৪ লক্ষ, যা মোট জনসংখ্যার ৮.১%- বাংলাদেশের ০ থেকে ১৯ বছরের টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৫৩৫০ জন। এটা উদ্বেগজনক।
তাই ‘সবার জন্য ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও সেবা নিশ্চিতকরণ’ এখন সময়ের দাবি। সরকারের পক্ষ থেকে যেভাবে সেবা নিশ্চিতকরণের জন্য কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে, তাতে সন্তোষ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। বলা বাহুল্য, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক সরকারি হাসপাতালে ডায়াবেটিস রোগীদের বিনামূল্যে ইনসুলিন দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে ডায়াবেটিস রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। আগামীতে ইনসুলিনও ফ্রি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এই কথা বলেন।
জাহিদ মালেক বলেন, সবার জানা প্রয়োজন, শহর বা গ্রামের প্রতিটি হাসপাতাল থেকেই এখন বিনামূল্যে ডায়াবেটিস রোগের প্রায় সকল ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি খুব দ্রুতই ডায়াবেটিস রোগের জন্য ব্যয়বহুল চিকিৎসা সামগ্রী ইনসুলিনও বিনামূল্যে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকারের অন্যান্য জটিল রোগের চিকিৎসা সেবা বিনামূল্যে পাবার পাশাপাশি ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসাও মানুষ ঘরের পাশে থাকা যেকোনো হাসপাতাল বা কমিউনিটি ক্লিনিকেই পাবেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের পাশাপাশি শহরের মানুষজনও অনেকেই ডায়াবেটিস নিয়ে তেমন একটা সচেতন নয়। একটি জরিপ থেকে জানা গেছে, দেশের মাত্র ১২ ভাগ মানুষের ডায়াবেটিস এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আবার অনেক মানুষই চিকিৎসার টাকার অভাবে ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে যান না।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা প্রাপ্তি যেমন সকলের অধিকার, তেমনি সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ জরুরি। এর পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।বিশেষজ্ঞদের মতে, হাঁটাচলা, খাবার অভ্যাস ও জীবনযাপনে পরিবর্তনসহ কিছু নিয়মকানুন মানলে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব।