করোনা মহামারিতে দুই লাখ মানুষের মৃত্যু। নাজুক অর্থনীতি। বৈষম্যের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে নাগরিক আন্দোলন। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী রাজনীতিতে এসব ইস্যু ছাপিয়ে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি। দুই প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনের মধ্যে প্রথম সরাসরি বিতর্কে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি উঠে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক হতে শুরু করেছে। ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আবার অভিশংসন করার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর কয়েক সপ্তাহ বাকি। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে আগাম ভোট ও ডাকযোগে ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ২৯ সেপ্টেম্বর দুই প্রার্থীর সরাসরি বিতর্কের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত। এই বিতর্ক কতটা উত্তপ্ত হবে, রাজনীতির মাঠে তা কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে অনুমান করতে প্রস্তুত নন বিশ্লেষকেরা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রচার শিবিরের জনসংযোগ পরিচালক টিম মুর্তোফ বলেছেন, নিঃসন্দেহে সরাসরি বিতর্কে বিচারপতি নিয়োগের ইস্যুটি সামনে চলে আসবে। গত সপ্তাহান্তে বিচারপতি রুথ গিন্সবার্গের মৃত্যুর পর থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এই বিতর্কে ইতিমধ্যে জড়িয়ে পড়েছেন দুই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী; পাশাপাশি আমেরিকার রাজনীতি ও সমাজমনস্ক লোকজনও। শুরু থেকেই ডেমোক্রেটিক পার্টি ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণের পর বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে। এ নিয়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন, কংগ্রেসের স্পিকার, সিনেটে ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা প্রতিদিনই বক্তব্য দিচ্ছেন।
রুথ গিন্সবার্গের মৃত্যু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নতুন বিষয় নিয়ে বিতর্কের সুযোগ করে দিয়েছে। এই বিতর্কে তার অবস্থান সুবিধাজনক স্থানে। সংবিধান তার পক্ষে। সিনেটে তার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। আমেরিকার যে জনগোষ্ঠীকে উদ্দীপ্ত করে তার রাজনীতি, সেই রক্ষণশীল গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার অমোঘ হাতিয়ার এখন ট্রাম্পের কাছে।
তিনি অল্প বয়সের কোনো পরীক্ষিত রক্ষণশীলকে বিচারপতি হিসেবে মনোনয়ন দেবেন। আমেরিকায় আগামী ৩০ বছরের রক্ষণশীল ধারণার প্রাধান্য নিশ্চিত করার মোক্ষম ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তার দম্ভ প্রকাশ করবেন। ট্রাম্প বলেছেন, আগামী শুক্র বা শনিবারের মধ্যেই এই ঘোষণা দেবেন তিনি। তার এ কথার পর লড়াই আরও জমে উঠছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুরো নির্বাচনী বিতর্কে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টিকে অগ্রভাগে নিয়ে আসার প্রয়াস নিচ্ছেন।
কোভিড-১৯ সামাল দিতে ব্যর্থতা বা বিপর্যস্ত অর্থনীতি নিয়ে ট্রাম্পকে কথা যত কম বলতে হবে, ততই মঙ্গল বলে তিনি ও তার সমর্থকেরা মনে করছেন। এ নিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে একাধিক হুমকি দেওয়া হয়েছে। দলটির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন বলেই দিয়েছেন, তিনি নির্বাচিত হলে ট্রাম্পের মনোনয়নে হওয়া বিচারপতিকে অপসারণের উদ্যোগ নেবেন।
ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে সবচেয়ে আশাবাদী ভাবনা হলো ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে জো বাইডেন জয়ী হবেন। সিনেটে অন্তত চারজন রিপাবলিকান সদস্য পুনর্র্নিবাচিত না-ও হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও ডেমোক্র্যাটদের হাতে চলে আসবে। এমনটা হলে সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী ডেমোক্রেটিক পার্টি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে অপসারণের উদ্যোগ নিতে পারে।
ডেমোক্র্যাটদের এই পরিকল্পনা অনেকগুলো যদির ওপর নির্ভর করছে। নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের বিশাল জয় এলে তারা ওয়াশিংটন ডিসিকে পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা দিয়ে আইন পাস করতে পারে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন সিনেটে আরও দুজন সিনেটরের পদ সৃষ্টি হবে। ডেমোক্র্যাটদের ওয়াশিংটন ডিসি থেকে সহজেই নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ আছে। কংগ্রেস থেকে ফিলাবাস্টার (টানা বক্তৃতা দিয়ে প্রস্তাব গ্রহণে বাধা প্রদান) নামের আইনটি বাতিল করা হতে পারে। কংগ্রেস ও হোয়াইট হাউস দখলে নিলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বর্তমান সংখ্যা নয় থেকে বাড়ানোর উদ্যোগও তারা গ্রহণ করতে পারে। এমন ক্ষেত্রে উদারনৈতিক বিচারপতিদের নিয়োগ দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে ভারসাম্য নিয়ে আসা হবে বলে ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি নতুন করে হুমকি দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টি নির্বাচনের আগেই বিচারপতি নিয়োগের উদ্যোগ নিলে তাদের কাছে তা মোকাবিলার অস্ত্র আছে। এবিসি টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডেমোক্র্যাট স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, কিছুই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তারা দেশের গণতন্ত্র ও মূল্যবোধ রক্ষায় যেকোনো রাজনৈতিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত আছেন। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা অ্যাটর্নি জেনারেল উলিয়াম বারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব নেওয়া হতে পারে। এমন প্রস্তাব আনা হলে সিনেটে ইমপিচমেন্টের বিচারপ্রক্রিয়া উন্মুক্ত করতে হবে। এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগে ট্রাম্পের উদ্যোগকে বিলম্ব করার প্রয়াস নিতে পারে ডেমোক্রেটিক পার্টি।
সিনেটে রিপাবলিকান পার্টির অন্তত দুজন সদস্য ইতিমধ্যে বলেছেন, তারা তাড়াহুড়ার পক্ষে নেই। সিনেটর মিট রমনি এখনো তার অবস্থান পরিষ্কার করেননি। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিপক্ষে তার দলের কয়জন সিনেটর প্রকাশ্যে অবস্থান নেন, তা দেখার অপেক্ষায় আমেরিকার রাজনৈতিক মহল। আবার ডেমোক্রেটিক পার্টির কোনো সিনেটরও দলীয় অবস্থানের বাইরে গিয়ে যে ভোট দেবেন না, তা-ও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
বিচারপতির নাম ঘোষণার আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন হিসাব নিকাশ পরিষ্কার করে নেবেন বলেই মনে করা হয়। শুধু নাম ঘোষণা করে বিতর্ককে আরেক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টিকে ট্রাম্প তাঁর রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখছেন। তিনি নিজেকে উদ্দীপ্ত মনে করছেন। উদ্দীপ্ত তাঁর সমর্থকেরাও। কারণ, এই সুযোগে নির্বাচনী বিতর্কে নাজুক বিষয়গুলো ট্রাম্প এড়িয়ে যেতে পারছেন। যদিও এই পরিস্থিতি আমেরিকার উদারনৈতিকদের নিজেদের মতভেদ দূরে সরিয়ে রেখে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগও এনে দিয়েছে। জো বাইডেনও সুপ্রিম কোর্টের নতুন বিচারপতি নিয়োগের বিতর্ক থেকে লাভবান হতে পারেন বলে মনে করছেন তার সমর্থকেরা।