ঢাকার হাই কোর্টের সামনে প্লাস্টিকের ড্রামের ভেতর থেকে আশরাফুল হক নামে রংপুরের এক ব্যবসায়ীর খণ্ডিত লাশ উদ্ধারের ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানিয়েছে, তাকে কীভাবে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল বন্ধু জরেজ। প্রেমিকা শামীমাকে দিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা ছিল জরেজের। তবে আশরাফুলকে ঢাকায় আনার পর টাকা আদায় না করে কেন খুন করা হলো, সেটির স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে র্যাবের ভাষ্য, তাদের হাতে গ্রেপ্তার জরেজের প্রেমিকা শামীমার কাছ থেকে ফাঁদে ফেলে টাকা আদায়ের তথ্যই পাওয়া গেছে। এর বাইরে হত্যাকাণ্ডের কোনো মোটিভ ছিল কিনা নিশ্চিত হতে জরেজের বক্তব্যের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এদিকে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন জরেজকে শুক্রবার রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। প্রাথমিকভাবে পরকীয়ার জেরে আশরাফুলকে হত্যার কথা উঠে আসে। আর গ্রেপ্তার বন্ধুসহ দুই আসামিকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। খবর বিডিনিউজের।
সকালে ঢাকার কারওয়ানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জরেজের প্রেমিকা শামীমা আক্তার কোহিনুরের বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়। ওই নারীকে শুক্রবার কুমিল্লার লাকসাম এলাকার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হাই কোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের গেটের কাছে নীল ড্রাম থেকে খণ্ড–বিখণ্ড লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৬ টুকরো লাশের প্রথমে পরিচয় পাওয়া না গেলেও আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেইজ থেকে পরিচয় শনাক্ত করা হয়। জানা যায়, লাশটি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজলার গোপালপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের আশরাফুল হকের।
এ ঘটনায় শুক্রবার শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন নিহতের বোন। এ হত্যাকাণ্ডে নিহতের বন্ধু জরেজ নামে একজনকে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে খোঁজার কথা বলেছিল পুলিশ। রাতেই ডিবি পুলিশ জরেজকে এবং র্যাব কর্তৃক জরেজের প্রেমিকা শামীমাকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে।
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে র্যাব–৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন বলেছেন, গ্রেপ্তার শামীমার সঙ্গে ঘটনার প্রধান আসামি জরেজের প্রায় এক বছরের প্রেমের সম্পর্ক। জরেজ সম্প্রতি শামীমাকে বলেছিল, তার এক বন্ধুকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্লাকমেইল করে ১০ লাখ টাকা আদায় করা যাবে। এর মধ্যে জরেজ ৭ লাখ টাকা এবং শামীমা ৩ লাখ টাকা ভাগ করে নিবে বলে আলোচনা হয়। শামীমা ভিকটিম আশরাফুলের সাথে এক মাস আগে থেকে মোবাইলে যোগাযোগ শুরু করে তার প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। তাদের নিয়মিত অডিও এবং ভিডিও কলে কথা চলতে থাকে।
গত মঙ্গলবার রাত আটটার দিকে আশরাফুলকে নিয়ে ঢাকায় রওনা দেন জরেজ। বুধবার তারা শামীমার সঙ্গে দেখা করেন এবং তিনজন মিলে শনির আখড়ার নূরপুর এলাকায় সাড়ে ৫ হাজার টাকার একটি ভাড়া বাসায় উঠেন। এর মধ্যে জরেজ ও তার প্রেমিকা শামীমার মধ্যে আলোচনা হয়, আশরাফুলের আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করে সেটি দেখিয়ে ১০ লাখ টাকা আদায় করা হবে।
এটি অনেকটা হানিট্র্যাপের মতো মন্তব্য করে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, বুধবার দুপুরে ওই বাসায় ভিকটিম আশরাফুলকে মালটার শরবতের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হালকা অচেতন করে ফেলে জরেজ। আমরা সেদিনের ভিডিও শামীমার মোবাইলে পেয়েছি। ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করে টাকা আদায়ের পরিকল্পনা থাকলেও দুপুরে পুরোপুরি অচেতন আশরাফুলের হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে এবং মুখ স্কচটেপ দিয়ে আটকে দেয় জরেজ। একপর্যায়ে আশরাফুলকে হাতুড়ি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে।
র্যাব কর্মকর্তা ফায়েজুল আরেফীন বলেন, অতিরিক্ত আঘাত এবং মুখ স্কচটেপ দিয়ে আটকানো থাকায় শ্বাস না নিতে পেরে ঘটনাস্থলেই আশরাফুল মারা যায়। লাশ একই ঘরে রেখে জরেজ ও শামীমা বুধবার রাত্রিযাপন করে। বৃহস্পতিবার সকালে জরেজ কাছের বাজার থেকে চাপাতি ও ড্রাম কিনে আনে। এরপর আশরাফুলের লাশ ২৬ টুকরা করে ড্রামে ভরে রাখে।
দুপুর পৌনে তিনটার দিকে একটি সিএনজি ভাড়া করে ড্রাম দুটি সিএনজিতে নিয়ে তারা বেরিয়ে যায়। দুপুর সোয়া তিনটার দিকে তারা হাই কোর্ট মাজার গেটের কাছে লাশভর্তি ড্রাম রেখে দ্রুত চলে যায়, যেসব মুভমেন্টের সিসিটিভি ভিডিও রয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব। এরপর সায়েদাবাদ গিয়ে শামীমাকে কুমিল্লায় বাড়িতে চলে যেতে বলে জরেজ এবং নিজে রংপুর চলে যাবে বলে জানায়।
পরে শামীমার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আশরাফুলের রক্তমাখা সাদা রঙের পায়জামা–পাঞ্জাবিসহ হত্যার ব্যবহৃত দড়ি, স্কচটেপ, একটি গোল গলা গেঞ্জি এবং একটি হাফ প্যান্ট নূরপুর এলাকা থেকে উদ্ধারের কথা বলেছে র্যাব।
এক প্রশ্নের জবাবে ফায়েজুল আরেফীন বলেন, শামীমার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ব্লাকমেইল করে টাকা উপার্জন করায় তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পিছনে পূর্ব শত্রুতা আছে কিনা তা মূল আসামি জরেজকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসবে। একটু অপেক্ষা করলে আমরা মূল মোটিভটা জানতে পারব। কারণ যে নৃশংশতা হয়েছে, রিভেঞ্জ বা রাগ ছাড়া এভাবে মারাটা আমাদের কাছে স্বাভাবিক লাগেনি।
দুই আসামি ৫ দিনের রিমান্ডে : আশরাফুল হকের খণ্ডিত লাশ উদ্ধারের মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামিকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। তারা হলেন আশরাফুলের বন্ধু প্রধান সন্দেহভাজন জরেজুল ইসলাম ওরফে জরেজ এবং তার প্রেমিকা শামীমা আক্তার ওরফে শামীমা ওরফে কোহিনুর। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইসরাত জেনিফার জেরিন তাদের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দেন। প্রসিকিউশন বিভাগের এসআই জিন্নাত আলী এ তথ্য দিয়েছেন।











