শিক্ষা জীবনের একটি বড় সময় কাটিয়ে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার ব্যাকুলতা মনের কোণে কখনো জাগেনি তা নয়। তবে সেই ইচ্ছা বাস্তবে রূপান্তর করা আর হয়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ফেলে আসার ২৩ বছর পর শিমুল যখন কলা ভবনের আশেপাশের কিছু ছবি পোষ্ট করে, সেই ছবি মনের মাঝে আকুলতা জাগ্রত করে নিজেদের প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাসে আরো একবার ফিরে যাওয়ার জন্য।
২০২০ এর ডিসেম্বর মাসের শেষ শুক্রবার ছিল ২৫ ডিসেম্বর। এ-দিন সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াও যিশু খ্রীষ্টের জন্মদিন (বড়দিন) উপলক্ষে সরকারি ছুটি। সকালে তাজিন এবং সাদিয়াকে নিয়ে, করোনার মধ্যেই খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে তাই ঘুরে আসি ক্যাম্পাস হতে।
শাহবাগ মোড় হতে নির্মীয়মাণ মেট্রো রেলের পাশ ঘেঁসে অগ্রসর হয়ে প্রথমেই চলে যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণের স্পন্দন সম্বলিত টিএসসিতে। খবরে প্রকাশ টিএসসির বর্তমান অবকাঠামো ভেঙ্গে বহুতল ভবন হিসেবে গড়ে তোলা হবে। পৃথিবীর বহু উন্নত দেশে দেখেছি তাদের ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে সংরক্ষণ করতে। আমাদের দেশ এক্ষেত্রে সবসময় উদাসীনতার পরিচয় দেয়। সর্বদাই যে টিএসসি থাকে শিক্ষক এবং ছাত্রের জমজমাট আড্ডাস্থলরূপে। করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকায় তার সেই চিরচেনা প্রাণচাঞ্চল্যের অভাববোধ করলাম।
টিএসসি হতে বেরিয়ে এসে হেঁটেই রাস্তা পার হয়ে গেলাম ‘ডাস’এর সামনে। ডাসের ভাস্কর্যের চারপাশে এলোমেলো কাগজ এবং ময়লা ফেলে পুরো অংশটি নোংরা হয়ে রয়েছে দেখে খারাপই লাগলো।
রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে চলে গেলাম মলের মাঠে। মূলত নস্টালজিয়া আচ্ছন্ন করলো এখানে আসার পর আমাদের। বড় বড় গাছের নীচে একসময়ের সবুজ ঘাসে ঢেকে থাকা মাঠ কেন জানি আজ বড় বেশী রুক্ষ মনে হলো। হয়তো শীতের আগমনী বার্তা প্রকৃতির উপর রুক্ষতা এবং শুষ্কতার রূপ নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে। সাথে পেপার নিয়ে আসলে কিছুক্ষণ মাটির উপর বসতে পারতাম, তাজিনের এই আক্ষেপ একটু পর পরই আমাদের কানের কাছে বাজছিলো। একসময় এই মলের মাঠ ছিল আমাদের জন্য ক্লাসের বিরতির অবকাশযাপন স্থান।
মলের মাঠ হতে গেলাম ইউনিভার্সিটির বাস ডিপো এবং আমার কাছে রেজাল্ট আনার জন্য বুক ধড়ফড়ানি জায়গা রেজিষ্টার বিল্ডিং। বাসগুলি সারি-সারি দাঁড়িয়ে আছে এখনও। নেই শুধু বাসে করে ঘরে ফিরে যাবার তাড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থী এবং বাসের মামুরা।
লেকচার থিয়েটারের পাশ ঘেঁসে পিছন দিক হতে কলা ভবনে প্রবেশ করতেই মনে হলো কতদিনের সেই চিরচেনা গন্ডীতে যেন প্রবেশ করলাম । অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে প্রথমবারের মত তিনজন দাঁড়িয়ে ছবি তোলার অভিজ্ঞতা – এক কথায় অভূতপূর্ব।
নিজের প্রিয় ডিপার্টমেন্টে প্রবেশের গভীর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করোনার কারণে সেই ইচ্ছা দমন করতে হলো। কলাভবনের বিশাল কাঠের দরজায়, ততোধিক বিশাল তালা ঝুলায়ে লেখা রয়েছে ‘নো মাস্ক নো এন্ট্রি’। তাজিনকে বলেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর আমাদের সহপাঠি স্বরাজের সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে বেচারি সেই সময় আর করে উঠতে পারেনি।
হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম সেন্ট্রাল লাইবে্রিরর সামনে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ কিন্তু শীত শীত অনুভূতির লেশমাত্র যেন নেই। তিনজন আইসক্রিম নিয়ে ফিরে যেতে চাইলাম ফেলে আসা সেই দিনগুলির কাছে। ওখানে দাঁড়িয়ে বারবার আমার চোখ চলে যাচ্ছিলো মধুর ক্যান্টিনের দিকে। ছাত্রাবস্থায় যেখানে পদার্পন আমাদের জন্য কল্পনার বাইরে একটি বিষয় ছিল, আজও তেমনি দূর হতে দেখে ফিরে আসতে হলো।
সাদিয়া বা তাজিন কারোরই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ওরা যে হলের অনাবাসিক ছাত্রী হিসেবে যুক্ত ছিল সেই চীন মৈত্রী হলে যাবার তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আমি আগেই বলে রেখেছিলাম আমি আমার হল শামসুন নাহার হলে যাব। লোহার বিশাল দরজা যথারীতি এখানেও বন্ধ থাকলেও হলের ভিতরে প্রবেশের ইচ্ছা সময়স্বল্পতায় কিছুতেই সম্ভব হতো না। শামসু্ন নাহার হলের গেটের বাইরে একাত্তরের গণহত্যা বেদীর দিকে তাকিয়ে আরো একবার দেশের জন্য আত্মত্যাগকারী শহীদদের জন্য গর্ব অনুভব করলাম।
শামসুন নাহার হল হতে সামান্য এগোলেই শহীদ মিনার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার মাঝেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বহি:প্রাঙ্গনে ভাষার জন্য জীবন দানকারী শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার অবস্থিত। প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি তারিখে এখানে হাজার-হাজার মানুষ উপস্থিত হয়ে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে। শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে আমরা সেখানে কিছু সময় অতিবাহিত করি।
শহীদ মিনার হতে এরপর কার্জন হলের পথে। সময়স্বল্পতায় বন্ধ গেটের ওপাশে ঢোকা হয়ে উঠলো না। সরকারি ছুটি এবং করোনার কারণে বন্ধ ছিল চারুকলা ইন্সিটিউট, পাবলিক লাইব্রেরি এবং জাতীয় জাদুঘর।
পাবলিক লাইব্রেরির বাইরে নানা রঙ এর কাচের চুড়ি নিয়ে বসে থাকা খালাকে দেখে গাড়ি না থামিয়ে পারিনি। তিনজনই লম্ফ ঝম্ফ মেরে গাড়ি হতে নেমে গেলাম। বাহারি কাচের চুড়ি আমার খুব শখের হলেও বহু বছর তেমন কিছু পরা হয় না। প্রিয় দুজন মানুষকে সাথে পেয়ে অনেক বছর পর লাল কাচের চুড়িতে হাত সাজিয়ে নিয়ে ফিরে চললাম যার যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
সরকারী ছুটি এবং করোনার কারণে ক্যাম্পাসজুডড়ে কোথাও কোনো শিক্ষার্থী নেই, মানুষের হৈ চৈ নেই, কোলাহল নেই, সেভাবে নেই গাড়ির শব্দ দূষণ।
চির পরিচিত সেই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আজও যেন কেবল প্রকৃতির অন্তরঙ্গতা। ডালে-ডালে সবুজের সমারোহ। বেগুনি জারুল ফুলের চাদর, লাল কৃষ্ণচূড়ার শামিয়ানা (যদিও এ-সময় কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল থাকে না), ইউক্যালিপটাস বা আকাশমনি গাছের আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া আমাদের ভালবাসার ক্যাম্পাস।
জীবনের প্রয়োজনেই পরিবর্তন আসবে। পরিবর্তন আসবে মানসিকতায়, ব্যবহারে, পারিপাশ্বিকতায়।
বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়নের অংশ হিসেবে উত্তরা থেকে শাহবাগ মোড় হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝ দিয়ে মেট্রো রেল চলে গেছে টিএসসি হয়ে কাজর্ন হলের সামনে দিয়ে শিক্ষা ভবন হয়ে মতিঝিল।
হয়তো মেট্রোরেল যখন তার দুর্বার গতি নিয়ে সশব্দে ক্যাম্পাসের মাঝ দিয়ে চলতে শুরু করবে পাখির কলোরব আমরা কিছু সময়ের জন্য শুনতে পাবো না। কিন্তু সময়ের দাবিতেই এটুকু আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে।
যে-সময়টা চলে যায়, তার কাছে হাজার চাইলেও ফিরে যেতে পারি না। শুধু মাঝে মাঝে পিছু ফিরে স্মৃতিকাতর হয়ে উঠি। সময়ের পরিবর্তনে সোনালী অতীত বর্তমান হতে যতই আকর্ষণীয় মনে হোক না কেন, সেই আলো ঝলমলে সময়ে ফিরে যাওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি বর্তমান জীবনে অভ্যস্ত আমরা বোধহয় একটা পর্যায়ে এসে ফিরে যেতে চাইও না।