প্রীতিময় জীবনের জন্য চাই সুসম্পর্ক

কামরুন্নাহার রোজী | শনিবার , ১১ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:০০ পূর্বাহ্ণ

মানুষ ভালোবাসার কাঙাল এতে কোনো সন্দেহ নেই। মামেয়ে, বাপছেলে, স্বামীস্ত্রী, দেবরভাবি, ননদভাবি, বউশাশুড়ি, প্রেমিকপ্রেমিকা, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষকছাত্র, ডাক্তাররোগী, মালিককর্মচারি, নেতাকর্মী এমন অসংখ্য প্রিয় সম্পর্ক যখন বৈরি হয়ে ওঠে তখন কেমন লাগে? খুব তেতো নিশ্চয়। নিশ্চয় অনেকে হারিয়ে ফেলেন বেঁচে থাকার উদ্দীপনা। পরস্পর ভুল বোঝাবুঝি, স্বার্থপরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, ঈর্ষা, রেষারেষি, অর্থের কুপ্রভাব ইত্যাদি নানা জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা আমাদের সুন্দর সম্পর্কগুলোর মধ্যে ফাটল ধরায়। এতে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি নানা ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। এমনকি এতে দেশের উন্নয়নেও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যা মোটেই কাম্য নয়।

আমাদের ব্যক্তি জীবনে নানা স্তরের সম্পর্কগুলোয় ফাটল ধরতে ধরতে এক সময় তা গড়ে ওঠে দুর্ভেদ্য প্রাচীর। এর পেছনে যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। স্বার্থের গায়ে আঘাত হানলে শুরু হয় মানসিক যন্ত্রণা স্নায়ুযুদ্ধ। সেই থেকে অনেক খ্যাতিমান নারীপুরুষ কবি সাহিত্যিক শিক্ষক শিক্ষিকা বৈজ্ঞানিক দার্শনিক ঐতিহাসিক রাজনীতিবিদের এভাবে পরস্পরের মধ্যে ঘরে বাইরে যুদ্ধের ভাইরাস ছড়িয়ে সুন্দর সম্পর্কগুলো ভেঙে খান খান হয়ে যায়।

শিশুরাও বাদ পড়ে না এর মধ্যে। আগে কলেজ ইউনিভার্সিটি পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীতে প্রতিযোগিতা ঈর্ষা দ্বন্দ্ব চোখে পড়তো। এখন দ্বন্দ্ব সংঘাতের বীজ কিন্ডার গার্টেনের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও কিলবিল করতে দেখা যাচ্ছে। যেমন পাশাপাশি দুটো বাচ্চা বসে খেলা করছে। টিফিনের ভাগ দিচ্ছে, একটু হেরফের হয়েছে তো দিয়েছে কলম কিংবা পেন্সিলের খোঁচা বসিয়ে। কিংবা খেলতে গিয়ে বাসায় একজন আরেকজনের খেলনা দেখতে গেলো যেই অপরজনের চোখে পড়ল। অমনি দিলো জোরে কামড় বসিয়ে। চিকন চিকন ইঁদুরের মতো দাঁত খাবলে নিয়েছে এক টুকরো মাংস। ঝরে পড়ে রক্ত, শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এসব কোমলমতি ছাত্ররা স্কুল থেকে ডিসিপ্লিন গুড ম্যানার্সগুলো রপ্ত করলেও দিনের বাকি সময়গুলো ওরা বাড়িতে কাটায় যেখান থেকে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের চরিত্রের বিষাক্ত ছোঁয়া লাগে তাদের গায়ে। সেটা প্রভাবিত হয় স্কুলের অন্যান্য ছাত্রদের মধ্যে।

এভাবে একেকজন ঠুনকো মানসিকতার মানুষ জন্ম নিচ্ছে, কলুষিত করছে হৃদয়িক মানুষগুলোকে।

আবার দেখা যায় এক বাচ্চা আরেক বাচ্চাকে বলছেআমার আব্বুর লাল গাড়ি আছে। অপরজন বলছে আমার আব্বুর বিরাট একটা আকাশ আছে। অপরজন, আমার আব্বুরও আছে। এভাবেকচু আছে। আকাশ তো একটাই তোর আব্বুর থাকবে কিভাবে?

ঠিক তেমনি দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু অথবা ক্লাসমেটের মধ্যে যখন একজনকে বেশি প্রাধান্য দেয় কোনো অপরূপা ক্লাসমেট কিংবা ক্লাস টিচার কোনো সাবজেক্ট টিচার; তখনই ভেতরে ভেতরে দানা বেঁধে উঠতে থাকে শত্রুতার রেশ। ওই বন্ধুর যত নেতিবাচক দিক বন্ধু মহলের মধ্যে ফাঁস করতে থাকে। নানাভাবে তাকে হেয় করে। হয়তো বুঝতেই পারে না কেন এমন খারাপ ব্যবহার করছে তার প্রিয় বন্ধুটি।

আবার কোনো অহংকারী ফার্স্ট গার্ল অথবা ফার্স্ট বয় যখন দেখে সেকেন্ড গার্ল অত্যন্ত গুণসম্পন্ন। সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সদ্ভাব বজায় রাখে; আর অন্য সবাই তাকে খুবই সুনজরে দেখে তখনই শুরু হয় জ্বালাপোড়া।

অনেক সাধনা ও ভালোবাসার বদৌলতে বিয়ে করা স্ত্রী যখন অর্থের কুপ্রভাবে ক্লাব পার্টি বয়ফ্রেন্ড নিয়ে মেতে উঠে তখন স্বামী হয়ে ওঠে একা নির্বান্ধব। ধীরে ধীরে মধুর সম্পর্কে ঘুনে ধরে। আবার শুধু টাকার পেছনে হন্যে হয়ে ছুটতে থাকে যখন কোনো আদর্শবান স্বামী; নিঃসঙ্গ স্ত্রী তখন অবহেলায় বঞ্চনায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। নিজের পাওনার কথা তুলতেই স্বামীরত্নটি হয়ে ওঠেন বার্কিং ডগ। ফলে কেউ আত্মহত্যার পথে/অন্ধকার রাজ্যে নিজেকে বিসর্জন দেয়। এভাবে সংসারে একশ্রেণির মানুষ সহজাত সারল্য দিয়ে সুসম্পর্কের জাল বুনে আরেকশ্রেণির মানুষ কর্তৃত্ব আর ক্ষমতার লেলিহান শিখায় ছাই করে উড়িয়ে দেয়। এমনকি সংসারে সবার কাছে স্নেহের পাত্র হওয়ার ঈর্ষা তাদেরকে ধীরে ধীরে প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। নবীনকে জায়গা করে না দেয়ার কৌশল আঁটতে থাকে মনে মনে। সংসারের সব দোষ ভুলত্রুটি নবীনের ঘাড়ে চাপে। সংসারের চাবি হারানোর ভয়ে রাজত্ব হাতছাড়া হওয়ার দুশ্চিন্তায় সে সবার কাছে নবীনকে হেয় প্রতিপন্ন করে। এমনভাবে উপস্থাপন করে যাতে সবার কাছে প্রিয় পাত্রের বদলে ঘৃণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকে। অবস্থা এমন হয় যে, যত দোষ নন্দঘোষ। সংসারে বিবেকহীন ও অবিবেচক কম নয়, যারা একবারও তলিয়ে দেখে না যে, যাকে বারবার দোষারোপ করা হচ্ছে আসলে সে কতখানি দোষী। এভাবে আসল সত্য চাপা পড়ে।

মেধাবী তুখোড় কার্যকরী সাংগঠনিক ক্ষমতা সম্পন্ন কোনো জুনিয়র ছাত্র যখন রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করে তখনই দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকা নেতার মনে ঈর্ষার ঝড় ওঠে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে সে এমন কোনো কাজ নেই যে করে না।

শুধু তাই নয়। জাতীয় সংসদ ভবনেও দলাদলি টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক ঈর্ষার ঝড় ওঠে। পরস্পরের বিরুদ্ধে যুক্তি তর্কে কথার ফুলঝুড়ি ছড়ায়। কুৎসা রটায়। প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে। পরশ্রীকাতরতা পেয়ে বসে। ছোট্ট কোনো রেশ ধরে হরতাল ধর্মঘট মিটিং মিছিল আন্দোলন ওয়াকআউট করে। চেয়ার বদল গ্রহণ বর্জন এমনকি নিজেদের মধ্যেও দলাদলি শুরু করে দেয়।

ব্যবসায়ীরাও কম যায় না। কথার মারপ্যাঁচে প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ীকে ঘায়েল করার জন্য আঁটে নানা ধরনের ফন্দি। এমন এক সময় ছিল দুজনের মধ্যে গলায় গলায় ভাব। সময়ে তেতো হয়ে ওঠে। যখন পরম ব্যবসায়ী বন্ধুটি কঠোর পরিশ্রম ও মেধার বদৌলতে ব্যবসায় ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করে। এতে অপেক্ষাকৃত কম পরিশ্রমী অমেধাবী ব্যবসায়ী বন্ধুটি এমন সাফল্যকে কোণঠাসা করার জন্য মেতে ওঠে যত নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে। কিংবা কখনো একজন ব্যবসায়ী অন্য ব্যবসায়ীর ওপর ব্যবসার সমস্ত ভার দিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে। অন্য ব্যবসায়ীটি সেই বিশ্বাসের মূল্য না দিয়ে স্বার্থপরতার মতো হিসেবের গরমিল অথবা সুকৌশলে অর্থ আত্মসাৎ করে। অতঃপর.. নিজের জীবনের অপ্রাপ্তি ও ব্যর্থতাগুলো অন্যের মধ্যে চাপিয়ে দিয়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটায়।

আমরা তো সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবন মানে সম্পর্ক বজায় রাখা। সুসম্পর্কই তো আনন্দময় জীবনের মূল চাবিকাঠি। এই সম্পর্কের জন্য চাই জীবনকে বদলে নেয়া। একটু নমনীয় একটু সহনীয়, আর কী চাই?

অন্যের ভালো কাজের একটু প্রশংসা করলে তো সম্পর্কের নাগাল পাচ্ছেন। খুঁটিনাটি ভুলের জন্য সারাক্ষণ কর্কষ কাকের মতো না করে সহজ ভাষায় মাশুলের উপায় তুলে ধরুন। অন্যকে নিজের সব সমস্যা খুলে বলুন, নিজেকে লাঘব করুন। প্রতিদিন একটা একটা করে ভালো কাজ করার নিদর্শন গড়ে তুলুন। অপার সম্পর্কের পথ খুলে যাবে।

সবচে বেশি কাছের মানুষ মাকে দিয়ে শুরু করুন। অন্যদের বন্ধু ভাবার চেয়ে মাকে বন্ধু ভাবুন আগে। কেননা মা শাসন করবেন রটাবেন না। এ পৃথিবীতে মাই একমাত্র নিঃস্বার্থ বন্ধু। শ্বশুরবাড়িতে ননদের যে ধরনের অমানবিক ব্যবহার পেয়েছেন বা পাচ্ছেন বাপের বাড়িতে এসে তা ভাবির প্রতি প্রয়োগ করবেন না। উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য দুজনেই সচেষ্ট হোন। শাশুড়ি প্রথমে বউকে নিজের মেয়ের জায়গায়, বউ শাশুড়িকে মায়ের জায়গায় স্থান দিন। দোষ ত্রুটিগুলো নিয়ে দুঃখ পেয়ে অথবা ঘৃণায় কষ্টে মন খারাপ করে না থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করুন। আপনার আর বৌ এর মধ্যে চারিত্রিক গুণাবলী বেড়ে উঠা চলাফেরা রুচিবোধ যোগ্যতার মধ্যে পার্থক্য থাকতেই পারে। যুগ পাল্টেছে পাল্টেছে চারপাশ এটাও আপনাকে মাথায় রাখতে হবে।

স্বামী স্ত্রী একে অপরের বোধের অংশীদার হোন। সরাসরি আলোচনা করুন। কথাবার্তায় ব্যবহারে দুজন দুজনের প্রতি বিনয়ী ও মিষ্টভাষী হোন। পরস্পরের প্রিয় খাবার ও পোশাকের মূল্যায়ন করুন। মাঝে মাঝে আনন্দে উদ্বেলিত হবার মতো নতুন কিছু করে চমক দিন। নিজে ভালো থাকুন অন্যকে ভালো থাকতে দিন দেখবেন চারপাশ কত সুন্দর কত চমৎকার। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের সাথে পরস্পরের সুসম্পর্কেই গড়ে উঠুক ভালোবাসাময় একটি দেশ ও সমপ্রীতির একটি পৃথিবী।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধজনমত জরিপে বিজয়ের সম্ভাব্য পূর্বাভাস