কীভাবে লেখাটি শুরু করবো ভেবে পাচ্ছি না। বাদল ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর চলে যাওয়ার অল্প কয়েকদিন আগেও অনেকক্ষণ আড্ডা হয়েছিল আজাদী অফিসে তাঁর চেম্বারে। নিজের অসুস্থতার কথা বলছিলেন বটে কিন্তু এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন না। বলেছিলেন, যা হবার হবে, টেনশন করেন না, শেষ পর্যন্ত কাজ করে যেতে চান। তাঁর শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসছিল। সে কথা বলাতে তিনি বলেছিলেন, ‘সেটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু ভাবতে চাই না।’
বাদল ভাই, মঈনুল আলম বাদল, আজাদীর ব্যবস্থাপক ছিলেন। কিন্তু তিনি কেবল ব্যবস্থাপকই ছিলেন না, ছিলেন আজাদীর প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী, আজাদী প্রেমিক। পত্রিকাটিকে নিয়ে ভাবতেন। আমরা যারা লিখতাম সবাইকে অত্যন্ত সম্মান করতেন বয়স নির্বিশেষে। প্রকাশিত লেখা নিয়ে আলাপ করতেন।
বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল। সাহিত্য, চলচ্চিত্র, রাজনীতি, ক্রীড়া। বিশেষ করে ক্রিকেটের খুব ভক্ত ছিলেন। উনার সাজানো গোছানো চেম্বারটিতে একটি টিভি সেট ছিল। প্রায় সময় দেখতাম ক্রিকেট ম্যাচ দেখছেন। নয়তো আন্তর্জাতিক সংবাদ চ্যানেল। দেশি বিদেশি রাজনীতি নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা ছিল তাঁর মধ্যে। অসীম শ্রদ্ধাশীল ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি,বঙ্গবন্ধুর প্রতি। প্রায় সময় ১৯৬৯, ৭০ এবং ৭১– এর নানা স্মৃতি নিয়ে কথা বলতেন। এসব নিয়ে লিখতে বললে বলতেন, ‘আমাকে দিয়ে এ কাজটি হবে না।’
উপর থেকে দেখলে খুব রাশভারী মনে হতো তাঁকে। তাঁর দৈহিক গড়নও সমীহ জাগানো ছিল। কিন্তু যাঁরা তাঁর সঙ্গে মিশেছেন, তাঁর কাছাকাছি যেতে পেরেছেন, তাঁরা জানেন, কি মিশুক এবং প্রাণখোলা ছিলেন মানুষটি। খুব রসিক ছিলেন। আমাদের দুজনের প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো বিকেলে হাঁটার সময়। অনেক দূর থেকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে কাছে এসে মজার মজার কথা বলে আবার হাঁটতে থাকতেন। কেমন আছেন জানতে চাইলে সবসময় সে একই উত্তর, ‘মাশ আল্লাহ ভালো আছি’।
সবসময় পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন পোশাক–আসাকে, চলনে–বলনে। তাঁর চেম্বারটিও থাকতো অত্যন্ত পরিপাটি। দীর্ঘক্ষণ আড্ডা হতো সে চেম্বারে। কিন্তু কখনও পরচর্চা পরনিন্দা করতে দেখিনি তাঁকে। তবে একটা বিষয় খুবই পীড়া দিত আমাকে। তাঁর অবিরত ধূমপান। বারণ করলে বলতেন, এটা খারাপ হচ্ছে জেনেও ছাড়তে পারছেন না। শেষদিকে কমিয়ে আনলেও যা হবার তা ততদিনে হয়ে গিয়েছিল। এই চেন স্মোকিং তাঁর অসুস্থতার একটা বড় কারণ বলে মনে হয়, যা জানুয়ারির চার তারিখে তাঁর অকাল প্রয়াণকে ত্বরান্বিত করেছে।
ভালো সিনেমার খুব অনুরাগী ছিলেন বাদল ভাই। আমি পুরোনো কোনো চলচ্চিত্র, বিশেষ করে ধ্রুপদী চলচ্চিত্রগুলো নিয়ে লিখলে বিস্তারিত আলাপ করতেন ছবি, ছবির পরিচালক এবং অভিনয় শিল্পীদের নিয়ে। আমি অনেকটা অবাক হয়ে খেয়াল করতাম সিনেমার এই সাইলেন্ট লাভারের কথাগুলো। ক্যথরিন দালিউব এবং সোফিয়া লোরেনের পাঁড় ভক্ত ছিলেন তিনি। রিপালসান ও সানফ্লা খার ছবি দুটি বারবার দেখার প্রসঙ্গ নিয়ে বলতেন। তিনি ঢাকা থাকাকালীন (কৈশোর থেকে যুববয়স পর্যন্ত ঢাকাতে থাকতেন পরিবারের সঙ্গে) নাজ সিনেমায় ছবি দেখতেন। ঢাকার গুলিস্তান–নাজ এবং চট্টগ্রামের আলমাস–দিনার ছিল টুইন হল। নাজ ও দিনারের একটি চেইন ছিল। এ দু’টি হলে বিশ্ববিখ্যাত সব চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো। কুরোশাওয়া, ডিসিকা, বুনুয়েল, ভাইদা, পোলানস্কি, হিচককসহ অনেক বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকারের ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছি আমরা দিনারে, যা প্রথমে চলতো নাজে। পরে চট্টগ্রামে দিনারের মতো আরও দুটি সিনেমা হল চালু হয়, মেলোডিরিদম। এ দুটি হলেও ভালো ভালো প্রচুর বিদেশি ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছি আমরা। এসব সুখস্মৃতির রোমন্থন হতো বাদল ভাইয়ের সঙ্গে। আপ্যায়িত করতেন চা নাস্তা এবং একখানা আজাদী সহযোগে।
এরপরও লেখা জমা দেবো হয়তো। এ লেখাটিও জমা দিতে যাবো। কিন্তু সে চেয়ারে প্রিয় বাদল ভাইকে আর দেখতে পাবো না। জীবনের চাকা এভাবেই চলতে থাকে। জীবনেরই নিয়মে। তারপরও সে নিয়ম মেনে নিতে মন সায় দেয় না। প্রিয়জনদের মধুর সান্নিধ্যের স্মৃতিগুলো মনকে পোড়ায়, কাতর করে তোলে। তবুও সেই স্মৃতিগুলো যেন বারবার মনে পড়ে এটাই কামনা। কারণ মানুষটি এভাবেই মনের গভীরে জেগে থাকবেন জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলিতে।