প্রিয় নবীর (সা.) প্রাণের শহর মদিনা মুনাওয়ারা

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ৫ জুলাই, ২০২৪ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে পবিত্রতম শহর মক্কা শরিফ। এর পরেই যে নগরীটি তাদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র তা হলো মদিনা শরিফ। মক্কা শরিফে প্রিয় নবী (সা.) জন্মগ্রহণ করেন আর মদিনা শরিফে তিনি ইন্তেকাল করেন। নবীজির পবিত্র রওজাও মদিনা মুনাওয়ারায়। রাসুল (সা.) মক্কা শরিফকে অত্যধিক ভালোবাসলেও মদিনা শরিফের ভালোবাসাও ছিল তাঁর হৃদয়ের মণিকোঠায়। নবীজি (সা.) মক্কা শরিফে নবুয়ত লাভ করলেও তা পূর্ণরূপে বিকশিত হয়েছে মদিনা শরিফে। মক্কাবাসী ইসলামের তারকাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার অপপ্রয়াসে প্রবৃত্ত হলেও মদিনাবাসী অনুক্ষণ নিবিষ্ট ছিল এই প্রদীপকে আরো অধিকতর প্রোজ্জ্বল করার প্রচেষ্টায়।এখানেই মক্কাবাসীর ওপর মদিনাবাসীর শ্রেষ্ঠত্ব। পবিত্র মদিনা মুনাওয়ারা মুসলমানদের প্রাণের ভূমি। মদিনা হলো নবীজির (সা.) শহর, শান্তির নগর। রাসুলে করিম (সা.) বলেন যে আমার রওজা জিয়ারত করল তার জন্য আমার সাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল। তিনি আরও বলেন যে হজ করল কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করল না সে আমার প্রতি জুলুম করল। মদিনার আগের নাম ছিল ইয়াসরিব। রাসুলে করিম (সা.) হিজরতের পর এই শহরের নাম হয় মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর।

প্রিয়নবী (সা.) এর প্রাণের শহর মদিনা মুনাওয়ারার দর্শনীয় স্থান :

মসজিদে নববী : নবীর মসজিদ। আরবিতে বলা হয় মসজিদে নববী। হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজ হাতে নির্মাণ করেন এ মসজিদ। মসজিদের নির্মাণকাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তিনি। অবস্থান সৌদি আরবের মদিনার কেন্দ্রস্থলে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার বছর ৬২২ সালে এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদের পাশেই ছিল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বসবাসের ঘর। মসজিদের দক্ষিণপূর্ব প্রােন্েত রয়েছে একটি সবুজ গম্বুজ। গম্বুজটি নবীর মসজিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ এ গম্বুজের নিচেই রয়েছে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর রওজা মোবারক। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মসজিদের পাশে যে ঘরে ইন্তেকাল করেন সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। হিজরতের পর রসুল (সা.) এর নিজ হাতে তৈরি এই মসজিদের সঙ্গে মিশে আছে সারা বিশ্বের মুসলমানের আবেগ ভালোবাসা মায়া ও মমতা। যে মসজিদকে কেন্দ্র করেই দেড় হাজার বছর আগে ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিলো এ মসজিদের নামই মসজিদে নববী।

প্রিয় নবীর রওজা শরিফ : মসজিদে নববীর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান নবীজি (সা.) এর রওজা মোবারক। হজরত আয়েশা (রা.) এর হুজরার মধ্যে তাঁর পবিত্র মাজার শরিফ অবস্থিত। এরই পাশে হজরত আবু বকর (রা.) এবং তাঁর পাশে হজরত ওমর (রা.) এর মাজার। এর পাশে আরেকটি কবরের জায়গা খালি আছে এখানে হজরত ঈসা (.) এর কবর হবে। প্রিয় নবীজি (সা.) এর কবর মদিনায় অবস্থিত। একে মাকবারা শরিফ বা রওজা মোবারক বলা হয়। এটি বর্তমানে মসজিদে নববীর অন্তর্গত। রওজা শরিফের ওপর সবুজ গম্বুজ অবস্থিত। তার পাশেই মসজিদে নববীর মিহরাবের ওপরে রয়েছে সাদা গম্বুজ। যে মসজিদের সবুজ গম্বুজের ছায়ায় ঘুমিয়ে আছেন শেষ নবী মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.)

রিয়াজুল জান্নাহ : রওজা শরিফ (যা পূর্বে নবীজি (সা.) এর ঘর ছিল) এবং এর থেকে পশ্চিম দিকে রাসুলে করিম (সা.) এর মিম্বার পর্যন্ত স্বল্প পরিসর স্থান টুকুকে রিয়াদুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগিচা বলা হয়। এই স্থানে স্বতন্ত্র (ধূসর সাদাটে) রঙের কার্পেট থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন আমার ঘর ও আমার মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থানে বেহেশতের একটি বাগিচা বিদ্যমান। এখানে ছয়টি ওস্তেয়ানা বা স্তম্ভ রয়েছে। প্রতিটি ওস্তেয়ানার একটি করে ইতিহাস রয়েছে। এখানে প্রবেশ করা মানে জান্নাতে প্রবেশ করা।

জান্নাতুল বাকি : মসজিদে নববীর পূর্ব দিকে অবস্থিত এই কবরস্থানে হজরত ফাতেমা (রা.), হজরত ওসমানসহ অসংখ্য সাহাবা, আউলিয়া, বুজুর্গ ও ধার্মিক মুসলমানের কবর রয়েছে। এর একপাশে নতুন নতুন কবর হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখানে শুধু একটি পাথর দিয়ে চিহ্নিত করা আছে একেকটি কবর। জান্নাতুল বাকি যেখানে ঘুমিয়ে নুরানি কাফেলা।

ওহুদের ময়দান : পবিত্র মদিনা শহরের ঠিক উত্তরুপূর্ব দিকে ঐতিহাসিক ওহুদ পাহাড় অবস্থিত। মসজিদে নববী থেকে এর দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। এই রণ প্রান্তরে হজরত হামজা (রা.) সহ ৭০ জন সাহাবি শহীদ হয়েছিলেন। এই ওহুদ প্রান্তরে বিধর্মীরা নির্মমভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দন্ত মোবারক শহীদ করে। এখানে একটি মসজিদ আছে।

মসজিদে কিবলাতাইন : হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই মসজিদ থেকে তৎকালীন কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে জোহরের নামাজ পড়ার সময় নবীজি (সা.) এর কাছে ওহি নাজিল হয় যে তুমি এখনই এই অবস্থায় কাবার দিকে কিবলা করে নামাজ সমাধা করো। (সুরা২ বাকারা,আয়াত : ১৪৪)

মসজিদে কুবা : এটি ইসলামের প্রথম মসজিদ। এটি রাসুলে করিম (সা.) এর নিজ হাতে তৈরি। মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদুল আকসার পরই মসজিদে কুবার সম্মান। এখানে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লে এক ওমরাহর সওয়াব হয়।

খন্দক প্রান্তর : খন্দক প্রান্তরের পাশে অতি অল্প পরিসর স্থানের মধ্যে পাশাপাশি ছয়টি মসজিদ আছে। এগুলো হচ্ছে মসজিদে ফাতাহ, মসজিদে সালমান ফারসি (রা.) মসজিদে আবু বকর সিদ্দিক (রা.), মসজিদে ওমর (রা.), মসজিদে আলী (রা.), মসজিদে ফাতিমা (রা.)

বদর প্রান্তর : এখানে ইসলামের বিজয়সূচক প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৪ জন সাহাবি এতে শাহাদাতবরণ করেন। বদর প্রান্তরএ শহীদদের কবর রয়েছে।

মসজিদে ছাকিয়া : বদরের যুদ্ধের সময় রাসুলে করিম (সা.) এই মসজিদে নামাজ পড়েছিলেন এবং মদিনাবাসীর জন্য দোয়া করেছিলেন।

মসজিদে জুমা : মদিনায় হিজরতের পর রাসুল (সা.) প্রথম এই স্থানে জুমার নামাজ আদায় করেন। পরবর্তীতে এখানে একটি মসজিদ তৈরি করা হয়। এ মসজিদে রাসুল (সা.) নামাজ আদায়ের পর থেকে মসজিদটির নাম ‘মসজিদে জুমা’ করা হয়। মসজিদে কুবা থেকে ৯০০ মিটার উত্তরে এবং মসজিদে নববীর ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে মসজিদটি অবস্থিত।

মসজিদে আবু বকর : ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) খেলাফতকালে তিনি এ মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ান। তাই এটি মসজিদে আবু বকর নামে পরিচিতি লাভ করে। যা মসজিদে গামামাহর উত্তরে অবস্থিত। এছাড়া ও মদিনায় আরো অনেক মসজিদ রয়েছে।

যে শহরে রাসূল (সা.) তাঁর পবিত্র জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন তাঁর পবিত্র পদধূলিতে যার প্রতিটি অণুপরমাণু পবিত্র হয়েছে তার শ্রেষ্ঠত্ব ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অন্য কোনো শহরের সঙ্গে তার তুলনা চলে না। মক্কা ও মদিনা শরিফ প্রতিটি মুমিনের কাছে বড় পবিত্র ও সম্মানিত। তাই যখন আমরা রাসূল মুহাম্মদ (সা.) এর রওজা শরিফের কাছে যাই তখন যে প্রেমের আকর্ষণ আত্মায় সৃষ্টি হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তা কেবল হৃদয় বেদনায় চোখের অশ্রু বিন্দুতে উপলব্ধির বিষয়। প্রত্যেক মুমিনকে আল্লাহতায়ালা মসজিদে নববীতে নবীজির রওজা জিয়ারতের তাওফিক দান করুন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদিনের শুরুটা যেভাবে হয় আমার
পরবর্তী নিবন্ধএকাত্তরের খণ্ডচিত্র : ২