আল্লাহকে পেতে হলে মহানবী (সা.) কে ভালোবাসতে হবে। এটাই প্রধান শর্ত। রাসূল (সা.) খুশি হলে আল্লাহ খুশি। রাসূল (সা.) অখুশি হলে আল্লাহ অখুশি। তাই রাসূলের (সা.) প্রতি ভালোবাসা ও মহব্বত রাখা ঈমানের অঙ্গ। রাসূলের (সা.) প্রতি ভালোবাসা ছাড়া কেউ মুমিন বলেই গণ্য হবে না। মুমিন হতে হলে মহানবী (সা.) কে ভালোবাসতেই হবে। প্রিয় নবির (সা.) ভালোবাসা পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়ার অন্যতম শর্ত। মুমিন মুসলমানের ঈমান পরিপূর্ণ হয়েছে কিনা তা বুঝার অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে রাসুলুল্লাহর (সা.) ভালোবাসা। কেননা প্রিয় নবীর সঙ্গে হজরত ওমর (রা.)’র এ সম্পর্কিত আলোচনাই তার প্রমাণ: হজরত ওমর (রা.) নবিজীকে বললেন ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসি তবে নিজের জানের চেয়ে বেশি নয়। নবিজী বললেন ওহু! তাহলে তো এখনো (ঈমান পরিপূর্ণ) হয়নি। যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ! যতক্ষণ না আমি তোমার জানের চেয়েও বেশি প্রিয় না হব ততক্ষণ তোমার ঈমান পূর্ণ হবে না। কিছুক্ষণ পর হজরত ওমর (রা.) বললেন আল্লাহর শপথ! এখন আপনি আমার কাছে আমার জানের চেয়েও বেশি প্রিয় হয়ে গেছেন। নবিজী (সা.) বললেন হ্যাঁ ওমর! এখন তোমার ঈমান পূর্ণ হয়েছে। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন তোমাদের কেউ ততক্ষণ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার বাবা–মা, সন্তান–সন্ততি ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হব। সাহাবায়ে কেরাম প্রিয় নবিকে ভালোবাসতেন তাদের জানের চেয়েও বেশি। মুমিন মুসলমানের জন্য এ ভালোবাসাই পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়ার অন্যতম শর্ত। আসুন জেনে নিই–প্রিয় নবির (সা.) প্রতি সাহাবাদের ভালোবাসা কেমন ছিল: নবী কারীম (সা.) কে ভালোবাসার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম (রা.)। তাঁরা সত্যিকারের নবীপ্রেমের বেনজীর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। হযরত আবু সুফিয়ান (রা.) ইসলাম গ্রহণের আগেই এই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন: আমি কাউকে এতটা ভালোবাসতে দেখিনি হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে তাঁর সঙ্গীরা যতটা ভালোবাসে।
হজরত আবু বকর (রা.) ভালোবাসা: তিনি বিশ্বনবীর (সা.) ভালোবাসায় ধন–সম্পদসহ সব কিছুই ত্যাগ করেছিলেন। নিজে না খেয়ে তাকে খাওয়ানোতেই পেতেন সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি। মক্কা থেকে মদিনার সফরের সময় ভেড়ার দুধ পানে পিপাসা নিবারণ করলেন প্রিয় নবি (সা.) আর তৃপ্ত হলেন হজরত আবু বকর (রা.)। তিনি বলেন মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার সময় আমরা এক রাখালের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সে সময় বিশ্ব নবি (সা.) খুব পিপাসার্ত। আমি ভেড়ার দুধ দোহন করলাম। তিনি তা পান করলেন আমি খুব আনন্দিত হলাম। সত্যি বলতে কি নবীজির (সা.) দুধ পান দেখে আমি তৃপ্ত হয়ে গেলাম।
হজরত ওমরের (রা.) ভালোবাসা: হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন একদিন আব্বাকে (হজরত ওমর) বললাম হজরত উসামা (রা.) কে আমার চেয়ে দ্বিগুণ ভাতা দেন কেন ? অথচ নবিজীর (সা.) সঙ্গে তাঁর চেয়ে আমি বেশি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আব্বাজান হজরত ওমর কে (রা.) জবাব দিলেন–দেখো! উসামার আব্বা হজরত যায়দ (রা.) তোমার আব্বা (ওমরের) চেয়ে আল্লাহর রাসুলের বেশি প্রিয় ছিলেন। আর উসামা তোমার তুলনায় আল্লাহর রাসুলের বেশি প্রিয়জন ছিল। আমি আমার ভালোবাসাকে রাসুলের ভালোবাসার উপর প্রাধান্য দিতে পারি না।
নবীর ভালোবাসায় প্রাধান্য লাভ: হজরত আব্বাস (রা.) মক্কা বিজয়ের দিন আবু সুফিয়ানকে প্রিয় নবির (সা.) কাছে নিয়ে আসলেন। তখনও আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেনি বরং কাফেরদের সরদার। এমন সময় হজরত ওমর (রা.) বিশ্বনবির কাছে আবু সুফিয়ানকে হত্যার অনুমতি চাইলেন। এবার হজরত আব্বাস বললেন হে ওমর! একটু শান্ত হও। আবু সুফিয়ান যদি তোমার গোত্রের কেউ হতো তবে তুমি এমনটি করতে না। হজরত ওমর বললেন থামুন আব্বাস! শুনুন আমার কাছে তোমার ইসলাম গ্রহণের মর্যাদা আমার বাবা খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ অপেক্ষা অনেক বেশি আনন্দের ছিল। তা কেন জানো? আমি জানতাম তুমি ইসলাম গ্রহণ করলে নবিজী (তোমার ভাতিজা) বেশি খুশি হবেন। হায়! আমার পিতাও যদি মুসলমান হতেন। মহানবী (স.) এর হিজরতের আগে আলী (রা.) কে নিজের বিছানায় শুয়ে থাকতে বলেন। অথচ এটি ছিল বাঁচা–মরার প্রশ্ন। কিন্তু রাসুলের ভালোবাসায় বিনাবাক্যে তা মেনে নেন। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কে যেদিন মহানবী (স.) হিজরতের কথা বলেছেন সেদিন থেকে হিজরতের রাত পর্যন্ত (প্রায় তিন মাস) বিছানায় পিঠ লাগাননি। কারণ রাসুল (স.) কখন ডাক দেন তাঁর উঠতে দেরি হয়ে যায় কি না।
হজরত সাওয়াদর (রা.) ভালোবাসা: বদর যুদ্ধের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধে সারি সোজা করছেন। তাঁর হাতে একটি তীর ছিল। হজরত সাওয়াদ (রা.) (ইচ্ছাকৃতভাবে) সারির একটু সামনে দাঁড়িয়ে যান। বিশ্বনবি তার সামনে এসে তাকে তীর দিয়ে মৃদু খোঁচা দেন আর বলেন সারি সোজা করে দাঁড়াও। এবার হজরত সাওয়াদ (রা.) নবিজীকে (সা.) বলেন আপনি আমাকে তীর দিয়ে খোঁচা দিয়ে কষ্ট দিয়েছেন। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। নবিজী (সা.) সাওয়াদের (রা.) হাতে তীর দিলেন আর নিজের পেট থেকে কাপড় সরালেন এবং সাওয়াদকে প্রতিশোধ নিতে বললেন। এ সুযোগে সাওয়াদ (রা.) নবিজীকে জড়িয়ে ধরলেন এবং চুমু খেতে শুরু করলেন। নবিজী বললেন সাওয়াদ! এমন কি করলে কেন? তিনি বললেন ইয়া রাসুলাল্লাহ! সামনে যুদ্ধ। বাঁচবো কিনা মরবো জানি না। মৃত্যুর আগে আপনার শরীরের একটু স্পর্শ পাওয়ার জন্যই এমনটি করেছি।
হজরত সুমাইয়ার (রা.) ভালোবাসা: ওহুদের যুদ্ধ শেষ। বিশ্বনবিসহ সাহাবাগণ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মদিনায় ফিরছিলেন। তারা বনূ দীনার গোত্রের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলেন তখন হজরত সুমাইয়া বিনতে কায়েসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। যুদ্ধ ফেরত সাহাবারা হজরত সুমাইয়াকে জানালেন তোমার স্বামী ভাই ও বাবা যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। ওয়াকেদির বর্ণনায় জানা যায় হজরত সুমাইয়া বিনতে কায়েস তার স্বামী ভাই ও বাবার শাহাদাতের কথা শোনার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে জানতে চাইলেন–নবিজী কেমন আছেন? তিনি বেঁচে আছেন তো! তারা (যুদ্ধ ফেরত সাহাবারা) বললেন আপনি যেমন কামনা করছেন। আলহামদুলিল্লাহ! তিনি ভালো আছেন। এবার হজরত সুমাইয়া (রা.)বললেন, তাহলে তাঁকে একটু দেখাও। আমি তাঁর জ্যোতির্ময় চেহারা মোবারক একটু দেখে নেই। রাসুলুল্লাহর (সা.) প্রতি ইশারা করে তাঁকে দেখানো হল। দেখা মাত্রই তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন–হে আল্লাহর রাসুল! আপনাকে সুস্থ পাবার পর সব বিপদ (স্বামী ভাই ও বাবার মৃত্যু) আমার কাছে তুচ্ছ। অর্থাৎ এখন আর আমার মনে আমার স্বামী, ভাই বা বাবাকে হারানোর কোনো কষ্ট নেই। আপনাকে সুস্থ পেয়ে সব কিছুই আমি ভুলে গেছি।
হজরত উম্মে হাবিবার (রা.) ভালোবাসা: কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা হজরত উম্মে হাবিবাহ। তিনি রাসুলুল্লাহর (সা.) স্ত্রী। মক্কা বিজয়ের আগে অষ্টম হিজরিতে আবু সুফিয়ান মদিনায় এসে তার (কন্যা উম্মে হাবিবার) ঘরে গেলেন। আবু সুফিয়ান ঘরে প্রবেশ করে বিশ্বনবির (সা.) বিছানায় বসতে গেলে নবি পত্নী উম্মে হাবিবাহ (রা.) বিছানা গুটাতে শুরু করলেন এবং বসতে বারণ করলেন। আবু সুফিয়ান তা দেখে বিস্মিত হলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন–মা আমি কি এ বিছানায় বসার উপযুক্ত নই! এবার হজরত উম্মে হাবিবাহ (রা.) বলেন, এটা রাসুলুল্লাহর (সা.) বিছানা। আর তুমি মুশরিক অপবিত্র। তাই আমি চাই না যে তুমি রাসুলুল্লাহর (সা.) বিছানায় বস। এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান মেয়ের ঘর থেকে বের হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। অর্থাৎ বিশ্বনবির ভালোবাসা ও সম্মানের কাছে আপন পিতাও ছিল তুচ্ছ।
আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের দেখানো পথে বিশ্বনবির আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণের তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।